উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের রহস্যময় স্থান বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল– যেখানে জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ হওয়ার কারণ আজও অমীমাংসিত।
পৃথিবী– এর গর্ভে আজও যে কত বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছে,
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ হেন অগ্রগতির পরিধিতে থেকেও,
তা হয়তো আমরা কল্পনা করতে পারি না।
৩ থেকে ৩.৫ লক্ষ বছর ধরে আমরা কতটুকুই বা চিনতে পেরেছি পৃথিবীকে?
এ যেন এক রহস্য-গোলোক।
স্টোনহেঞ্জ থেকে শুরু করে মিশরের পিরামিড, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ,
ভয়েজনিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, মেরি সেলেস্ট, এভারেস্টের অদ্ভুত নিখোঁজ ঘটনা,
প্রাচীন মায়ান শহরগুলোর অজানা বিলুপ্তি, পেকিং ম্যানের হাড় ও প্রাচীন নিদর্শন।
আবার মাউন্ট কৈলাস থেকে অ্যামাজন রেইন ফরেস্ট বা এরিয়া-৫১.
এ সব যেন আজও মানবসভ্যতার অস্তিত্বের সামনে,
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক অমীমাংসিত রহস্যের দরজা হয়েই,
যার ভিতরটা জমকালো অন্ধকারের এক অসীমতা।
আজ যে বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো, তা “বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।”
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটা রহস্যঘন এলাকা।
শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের গহীন রহস্য, বিস্তার করে আছে আধিপত্য।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অলৌকিক কাণ্ড মানুষকে শুধু বিভ্রান্ত ও মুগ্ধই করেনি,
বরং করেছে বিস্মিত, শঙ্কিত, কৌতুহলী, এমনকি আতঙ্কিত।
পৃথিবীর মানচিত্রে ত্রিভুজাকার এই অঞ্চলের তিনটে প্রধান বিন্দু হলঃ
আর এই তিন বিন্দু মিলিয়েই তৈরি হয় রহস্যে মোড়া এই স্থান,
যা আজ ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ নামে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী পরিচিত।
( মানুষ একসময় প্লাস্টিককে বলেছিল ‘সভ্যতার অলৌকিক আবিষ্কার।
কিন্তু বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদই, আজ সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে,
এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ হয়ে।
আর প্রকৃতির শরীর জুড়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত ক্ষত হয়ে।
পড়ুনঃ প্লাস্টিকের আবিষ্কার আজ কিভাবে হল পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অভিশাপ? )
সাল ১৯৫০, সেপ্টেম্বর মাস।
ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি শহর থেকে প্রকাশিত ও পরিচালিত এক দৈনিক সংবাদপত্র,
‘মিয়ামি হের্যাল্ড’-এর এক প্রতিবেদনে সাংবাদিক ‘এডওয়ার্ড ভান উইঙ্কেল জোনস’ প্রথম,
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময় নিখোঁজকে একসাথে বিশ্লেষণ করে রহস্য হিসেবে উপস্থাপন করে।
এর আগেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আশেপাশে জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটছিল,
কিন্তু যেহেতু তা মানবসভ্যতার জন্যে এক ‘রহস্যময় ঘটনা’ হিসেবে গুছিয়ে পরিবেশিত হয়নি,
তাই বিষয়টা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষনও তেমন করেনি।
এখানে বলে রাখা ভালো, ‘ট্রায়াঙ্গেল’ শব্দটা কিন্তু তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
ট্রায়াঙ্গেল ধারণাটা জনপ্রিয় হয়,
১৯৬৪ সালে একজন আমেরিকান লেখক ও ফ্রিল্যান্স গবেষক,
‘ভিনসেন্ট গ্যাডডিস-এর ‘দ্য ডেডলি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ নামক প্রবন্ধে,
প্রথমবার ‘ট্রায়াঙ্গেল’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার পর।
এ স্থান থেকে কখনও সমুদ্রের অদ্ভুত আচরণ, কখনও জাহাজ নিখোঁজ,
কখনও বিমান হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, মানুষের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে,
অদৃশ্য এক শক্তির উপস্থিতি।
১৯৫০-এর দশকে সাংবাদিক এডওয়ার্ড ভ্যান উইঙ্কল জোন্স,
প্রথমবারের মতন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নিখোঁজ ঘটনাগুলোর সাথে এলিয়েন,
বা ভিনগ্রহীদের সম্পর্কের ধারণা প্রকাশ করেন।
তিনি দাবি করেন, এলিয়েনরা তাঁদের মহাকাশযান নিয়ে এই অঞ্চলে আসে,
এবং জাহাজ ও বিমানকে নিখোঁজ করে।
পরবর্তীকালে এই তত্ত্বটা বেশ জনপ্রিয় হয় ও স্থান পায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও বইয়ে।
( উন্নয়নের নেশা, মুনাফা, ভোগ-বিলাসিতা ও প্রতিযোগিতায় বুঁদ হয়ে,
আমরা আজ নিজেদের পায়ের তলা থেকে কিভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি প্রকৃতি?
পড়ুনঃ অক্সিজেনের অভাবে তবে কি ছটফট করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? )
বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, এলিয়েন তত্ত্বের কোনো দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
ড. সাইমন বক্সাল, সাউথাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহাসাগরবিদ,
২০২৫ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দাবি করেন,
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ‘রোগ ওয়েভ’ নামে বিশাল আকৃতির,
এক অপ্রত্যাশিত সমুদ্র তরঙ্গের কারণে জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ হতে পারে।
১৯১৮ সালের USS Cyclops জাহাজ নিখোঁজের ঘটনায়,
তিনি এই রোগ তরঙ্গের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক, গবেষক ও লেখক এলিয়েন তত্ত্বকে সমালোচনা করেছেন।
ল্যারি কুশে, ১৯৭৫ সালে,
তাঁর প্রকাশিত বই ‘দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিস্ট্রি সলভড (Solved)– এ দাবি করেন,
এলিয়েন তত্ত্ব ভিত্তিহীন এবং নিখোঁজ হওয়ার পিছনে জুড়ে আছে প্রকৃত কারণ।
তিনি উল্লেখ করেন, অনেক নিখোঁজ হওয়া ঘটনা বাস্তবেই ঘটেনি,
বা সেগুলোর ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
অধিকাংশ মানুষের কল্পনায়ও,
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের সাথে জড়িয়ে আছে ভিনগ্রহী প্রাণীর অস্তিত্ব।
আবার অনেকে মনে করেন,
এখানে এলিয়েনরা তাঁদের মহাকাশযান নিয়ে আসে,
এবং জাহাজ ও বিমানকে নিখোঁজ করে।
কেউ কেউ তো আবার এও বলছেন,
এখানে একটা ‘স্টার গেট’ আছে, যা অন্য জগতের সাথে সংযোগ স্থাপন করে।
এলিয়েনের এই ধারণা কেবল একটা রহস্য নয়; এটা মানুষের ভয়ের,
কৌতুহলের এবং সীমাহীন কল্পনার প্রতিফলন।
আমরা যা জানি না, তা আমরা স্বয়ং পূর্ন করি কল্পনা দিয়ে।
এলিয়েন আসুক বা নাই আসুক, বারমুডার রহস্য মূলত মানব চেতনার এক প্রতিফলন।
এ প্রসঙ্গ কিন্তু জন্ম দেয় এক দার্শনিক প্রশ্নের–
কতটা অজানা আমাদের জন্যে চরম বাস্তব, আর কতটাই বা কল্পনা?
আমরা কি প্রকৃতির রহস্য দেখছি,
না কি আমাদের মন নিজেই তৈরি করছে সেই রহস্যের গহ্বর?
চার্লস বারলিটজের ‘দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ বইয়ে বলা হয়েছে,
অতলান্তিস ধ্বংসের পর এই অঞ্চলে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে।
পুরাণ বা কিংবদন্তি অনুযায়ী অতলান্তিস নামের মহাদেশ বা নগর ধ্বংস হওয়ার পরে।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞানীরা এটাকে নিছক কল্পকাহিনী মনে করেন,
তবে সে যাই হোক, এটা কিন্তু বহন করে এক দার্শনিক বার্তা।
পুরনো সভ্যতার ধ্বংসের প্রতিফলন আজও বাস করে মানুষের কল্পনায়।
মানুষ যখন অতীতের ধ্বংসকে বর্তমানের রহস্যের সাথে মেলায়,
তখন আমরা কেবল ইতিহাস পড়ি না; আমরা আমাদের অস্তিত্ব এবং সীমারেখা নিয়ে ভাবি।
অতলান্তিস আমাদের স্মরণ করায়, কিছু জ্ঞান চিরকাল থেকে যায় অপ্রত্যাশিত ও অজানাই।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে এক চ্যালেঞ্জের স্থান।
ঘূর্ণিঝড়, তীব্র বাতাস, গালফ স্ট্রিমের স্রোত– সবই মানুষকে পরীক্ষা করে।
আমরা জানি বিপদ আছে, তবু আমরা আকৃষ্ট হই।
এখান থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়, ভয় কেবল অন্ধকারের প্রতীক নয়।
বরং ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার সংমিশ্রণই মানুষের সাহস, কৌতুহল এবং প্রজ্ঞার প্রতিফলন।
আমরা যা জানি না, তাতেই আমরা আকৃষ্ট হই; আমরা যা পারি না, তাতেই আমরা সাহসী হই।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে জনমনে যে আতঙ্ক, উৎসাহ, কৌতুহল বা আগ্রহ আজ পৌঁছেছে চরম সীমায়,
এর জন্যে মিডিয়া বা চলচ্চিত্রের অবদান অনস্বীকার্য।
অতিরঞ্জিত উপস্থাপন মানুষের কল্পনাকে উস্কে দেয়, এটাই স্বাভাবিক।
এমন বেশ কিছু ঘটনাই উপস্থাপন করা হয়েছে অতিরঞ্জিতভাবে,
যার ফলে প্রকৃত কারণই চলে গেছে আড়ালে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পিছনে,
আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এলিয়েন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া না গেলেও,
একেবারে একে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়াটাও যুক্তিসংগত হবে না।
তবে গবেষকদের ইঙ্গিত অনুযায়ী–
হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া রোগ তরঙ্গ,
জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেমকে পঙ্গু করতে সক্ষম,
জিওম্যাগনেটিক অস্বভাবিকতা কিংবা সমুদ্রতলের মিথেন গ্যাস নির্গমনের ফলে,
জাহাজের ভেসে থাকার অক্ষমতা,
এ ধরণের প্রাকৃতিক কারণগুলোকেই বর্তমানে আপাতত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে ধরা হয়।
তবু প্রশ্ন আজ রয়ে যায়– যদি সবকিছুরই ব্যাখ্যা থাকে,
তবে শতাব্দী ধরে কেন এই অঞ্চলের নাম উচ্চারিত হলেই মানুষের শরীরে জেগে ওঠে শিহরণ?
কেন প্রতিটা নিখোঁজের পরেও আমরা যুক্তির বদলে ঝুঁকে পড়ি কল্পনার দিকে?
তবে এলিয়েন তত্ত্ব প্রমাণিত না হলেও,
মানুষের কল্পনার গভীরে এ যেন আজ নাড়াচাড়া করে অদৃশ্য তরঙ্গের মতন।
মানবতার মন্দিরে ধর্ম এক সুর সে মানুষ হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, কিংবা হোক বৌদ্ধ, জৈন…
হারানো সভ্যতার নিঃশ্বাস ঘন জঙ্গলের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পাথরের দেয়াল; লতা-গুল্ম যেন সময়ের…
রাজনীতি এখন ধর্ম নয়, রক্তচাপ মানুষ এখন শুধু ভোটে রাজনীতি করে না– রাগে, ভালোবাসায়, ঘুমে,…
ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের খাঁড়ায় বিশ্বাস ও অস্থিরতা মানুষের মন বহুবার একই জায়গায় এসে…
পৃথিবীঃ এক ঘূর্ণনশীল অবিরাম রহস্যের জন্মভূমি পৃথিবী আমাদের জন্মভূমি, এক অবিরাম রহস্যের ঘূর্ণায়মান গ্রহ। আমরা…