আমরা বিকাশবাবুর যুগের মানুষ!

বিকাশবাবু, মানুষ নাকি রিমোট-কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব?

বিকাশবাবুকে দেখে অবাক হয়েছে বহুজন।
কিভাবে সম্ভব?
এ যেন চলে-ফিরে বেড়ানো অবিকল এক মানুষ।
দু হাত, দু পা, শিরা-ধমনী, মাঝে একটা মুখ।
আবার জামা-প্যান্ট পরে, খায়, ঘুমায় মানুষের মতই।
কিন্তু মনে রাখে প্রাইভেসি, ঝাপসা আবেগের কোনো ছায়া নেই।

মহাবিশ্ব তাঁর ড্রয়িংরুম

আত্মবিশ্বাসটা তাঁর বরাবরই বেশি।
তিনি দৃঢ়বিশ্বাসী– মহাবিশ্ব তাঁর ড্রয়িংরুমেই।
কারণ তিনি খবর দেখেন টিভিতে নয়, নিজের মাথার রিমোটে।
চ্যানেল পরিবর্তন মানে মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণ।

পিউরিফায়ার আর প্রাইভেসি

চোখে তাঁর জল নেই, থাকে পিউরিফায়ারে।
পাশের বাড়ির কারও কাশি হলে, তিনি দরজা বন্ধ করেন,
কারণ ভাইরাস নির্দয়।
তিনি মানুষ নয়, বোঝেন শুধু প্রাইভেসি সেটিং।

মৃত্যু ও ক্রিকেট ম্যাচ

কারো মৃত্যু হলে–
রিমোট বুকে চেপে ফিসফিসিয়ে জানান,
“ও তো বহুদিনের অসুস্থতা, সবই ঈশ্বরের হাতে।”
এরপর নির্বিকার আঙুলে চালিয়ে দেন টিভিতে,
ভারত-পাকিস্থানের ক্রিকেট ম্যাচ।
যেন মৃত্যু এক বিজ্ঞাপনের পরবর্তী প্রোগ্রাম মাত্র।

করুণা, ধুলো আর দেশপ্রেম

আত্মবিশ্বাসটা তাঁর মূল সম্পদ,অহঙ্কার।
কেউ অসুস্থ হলে, মন-প্রাণ ঢেলে শেখান–
“দেখিস মা, করুণা যেন না ছড়ায় ঘরের মেঝেতে,
ধুলো ছড়ায় ছড়াক।”
ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে তিরঙ্গা লাগিয়ে,
তিনি দেশকে বাঁচিয়ে আসছেন আজ ৩০ টা বছর।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও বিদেশি হালুয়া

গ্লোবাল ওয়ার্মিং?
সে আবার কোন কোম্পানির নাম?
দৃপ্ত ভঙ্গিতে তিনি ভাবেন–
হতেই পারে এ কোনো এয়ার কন্ডিশনের নতুন মোড।
আর গরম হলেও–  AC তো তাঁকে ঠান্ডাই রাখে।
একদিন ছেলে জিজ্ঞাসা করলো–
“বাবা, গ্লেশিয়ার কি?”
গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন– “ওটা বিদেশি হালুয়া।”
প্রশ্ন মিটে গেল, পৃথিবীও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

( তোমার দেশে আজ বীরের মেলা-
কিন্তু তোমার মতন বীর আজ আর জন্মায় না।

রাজমিস্ত্রি আজও দেওয়াল গাঁথে-
কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবকই, তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দেওয়ালে,
আজ তোমার আদর্শ আর গাঁথে না।
তাই ঘরে ঘরে জন্ম নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক সন্তান।
পড়ুন– Click: শ্রদ্ধেয় নেতাজী, তোমাকে খোলা চিঠি! )

শীলদার ষড়যন্ত্র

বিকাশবাবুর আদর্শ, তাঁর পরিবারের পাথেয়।
রাতে পেঁয়াজ শেষ হলে স্ত্রী ঘোষণা করে–
“পৃথিবীর সব বিপর্যয়ের শুরু এই শীলদার থেকে!”
বন্যা, খরা, ভূমিকম্প– এ সবই শীলদার ষড়যন্ত্র,
আর মানুষের দুঃখ?
তা রান্নাঘরে এসে আছড়ে পরলে, তবে জরুরী।

ইতিহাস গড়ার গুরু

দেশি-বিদেশি বই পড়ায় বিকাশবাবুর আগ্রহ,
ছাড়িয়ে যায় মিল্কিওয়ে।
রাজা রামমোহন, নেতাজী সুভাষ, বেগম রোকেয়া–
ধরে ধরে মুখস্থ করিয়েছে ছেলে-মেয়েটাকে।
কিন্তু পাশের বাড়ির ঠাকুমা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলে–
নির্লিপ্ত গলায় বিকাশবাবু বলেন–
“ওসব আর পাঁচজনের কাজ, আমি ইতিহাস গড়ছি।”

ভুলুটা এবং বিকাশবাবুর শিক্ষা বৃষ্টি

আত্মবিশ্বাসটা তাঁর বরাবরই বেশি।
সেদিন বাজারে ভুলুটা প্রশ্ন করে বসে–
“বিকাশদা, এত বড় বড় মানুষদের বই পড়াও,
সমাজের জন্যে কিছু মন চায় না?”
মন খোলা মুচকি হেসে তিনি উত্তর হাঁকেন–
“ওরে বোকা, বাস্তবজ্ঞানহীন, ইতিহাস পড়ার জন্যে,
অনুসরণের জন্যে নয়।
আগুন দেখলে কি হাত দিই, নাকি শুধু Like করি?

পরিবারই আসল বিশ্ব

এরপর গর্বিত হাসি দিয়ে যোগ করলেন–
মনে রাখিস, পরিবারই আসল বিশ্ব।
পৃথিবী ধ্বংস হয় হোক, ফ্রিজটা যেন চলে,
এটাই মানবতা, এটাই বাস্তব।

বিকাশবাবুর সভ্যতা দর্শন

আত্মবিশ্বাসটা তাঁর আকাশকেও লজ্জা দেয়।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি তাঁর চাবি।
কখনও কখনও আমি ভাবি–
এরা কি সত্যিই খারাপ, না বেশি বুদ্ধিমান?
কারণ এরা কাউকে কষ্ট দেয়না।
নিজেদের আরামে এরা এতই ব্যস্ত যে,
অন্যের দুঃখ, সমাজ বোঝার সময়ই পায় না।
এরা তো জানে নিজেকে বাঁচানোই সভ্যতা।
নিজের দরজা আঁটোসাটো করাই উন্নতির চাবি।

ভয়ে-ভয়ে বাঁচা আমাদের যুগ

তাই আজ ভয়ে-ভয়ে বাঁচি।
বেশি ভদ্র, বেশি পড়ুয়া, বেশি যুক্তিবাদী দেখলেই,
প্রশ্ন করে বসি–
“আপনি কি বিকাশবাবুর আত্মীয়?”
আর ভাবি–
আমরা আসলে বিপদের মধ্যে নই,
বাস করছি বিকাশবাবুর যুগে,
যে নিজের ছোট্ট সুখের থালায়–
পুরে ফেলতে চাইছে গোটা পৃথিবীকে।

 

 

 

 

 

 

 

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

দুই নেকড়ে (ধর্ম ও রাজনীতি) একটা থালা থেকে রক্ত খাচ্ছে , সেই রক্তে পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। তাদের পিছনে দুটো পতাকার একটায় লেখা– "বিশ্বাসে বাঁচো," অন্যটায় লেখা– "আমায় মানো।" আর সামনে রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে পথের মতো, যাতে অসংখ্য মানুষের ভিড়।

দুই নেকড়ে!

নেকড়ের যুগে হারানো মানবতা দুজন যেন দুই নেকড়ে, একই থালায় রক্ত খায়। একজন বলে, “বিশ্বাসে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *