চাঁদের Far Side থেকে কল্পিত পর্যবেক্ষণ– যেখানে অতীত ও বর্তমান মিশন যেন একসাথে বুনে দিয়েছে মানব অনুসন্ধানের ইতিহাস।
চাঁদের স্নিগ্ধতা, সৌন্দর্য, মোহময়ী রূপকে কল্পনা করে রচিত হয়েছে কত গান,
করা হয়েছে কত তুলনা?
একসময়, এমনকি মানুষ দেবতাকেও কল্পনা করেছে চাঁদে।
ছোটোবেলায় মা, ঠাকুমারা আমাদের বলতেন– চাঁদে বুড়ি চড়কা কাটে বসে বসে,
আর সেই ধারণাই বসে গেছিল আমাদের অবিবেচক মনে।
এরপর সময়ের সাথে সাথে বদলে গেল ধারণা।
প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে বিজ্ঞান এক নতুন পরিচয় দিল চাঁদের।
এককথায়– মানব সভ্যতার ইতিহাসে চাঁদ সর্বদাই আমাদের কাছে এক রহস্যের প্রতীক,
কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু, বিশেষ করে–
বিজ্ঞানী, গবেষক থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে,
আজ চাঁদের না দেখা দিক নিয়ে আগ্রহ, মাত্রা ছাড়িয়েছে এর সীমার।
প্রথমে জেনে নিই Tidal Lock কি?
এটা এমন এক অবস্থা, যখন কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নিজের ঘূর্ণনের গতি,
আর অন্য একটা বস্তুকে প্রদক্ষিণ করার গতি, দুটো এক হয়ে যায়।
ফলে– ওই বস্তু সবসময় একই দিক থেকে অন্যটিকে দেখায়।
উদাহরণঃ চাঁদ প্রতি চন্দ্র মাসে ২৭.৩ দিনে নিজের অক্ষে একবার ঘোরে।
তাই পৃথিবীর দিকে সবসময় একই দিকে থাকে।
এই দুই সময় সমান হওয়ার কারণেই, চাঁদের যে পাশটা পৃথিবীর দিকে থাকে,
সেটা সর্বদা একই থাকে, অন্য পাশ আমরা কখনই দেখতে পাইনা।
এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো– শুধুমাত্র চাঁদই পৃথিবীর সাথে Tidal Lock হয়নি,
আমাদের পৃথিবীও ধীরে ধীরে সূর্যের সাথে Tidal Lock হতে পারে বিলিয়ন বা ট্রিলিয়ন বছর পরে।
সে সময়ে যদি থাকে মানুষের অস্তিত্ব (কোনো মিনিমাম সম্ভাবনা নেই),
তো তাঁরা দেখবে–
পৃথিবীর এক দিক সবসময় সূর্যের দিকে, অন্য দিক হবে চির অন্ধকার।
আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞানে অত্যন্ত শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত এক ধারণা হল–
সূর্য এখন মেইন সিকুয়েন্স পর্যায়ে আছে, যেখানে হাইড্রোজেন জ্বালিয়ে,
শক্তি তৈরি করছে।
আনুমানিক প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পরে, ধীরে ধীরে শেষ হবে হাইড্রোজেন ফিউশন।
তখন সূর্য এর বাইরের আবরণ ফুলিয়ে ধারণ করবে বিশাল আকার,
যাকে বিজ্ঞান নাম দিয়েছে– লাল দানব নক্ষত্র (Red Giant).
মানব প্রজাতির অস্তিত্ব সে সময়ে থাকলেও (সম্ভাবনা ০%),
তা কিন্তু একেবারেই বাসযোগ্য থাকবে না।
(প্লাস্টিক আমাদের সভ্যতাকে অনেক সুবিধা দিয়েছে,
কিন্তু এখন তা পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর অভিশাপে।
ক্লিক করে পড়ুনঃ প্লাস্টিকের আবিষ্কার আজ কিভাবে হল পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অভিশাপ?)
চাঁদের যে অংশ আমাদের দিকে থাকে, তাকে বলা হয়– Near Side.
চাঁদের যে অংশ আমাদের দিকে থাকে না, তাকে বলা হয়– Far Side.
Far Side– নামটা বেশ বিভ্রান্তিকর, এই দিকটা সবসময় অন্ধকার,
তা আদৌ নয়।
সূর্যের আলো এখানেও সমানভাবে পড়তে থাকে।
আমরা তা সরাসরি দেখতে পাই না, কারণ ভৌগোলিকভাবে এই দিকটা,
সবসময়েই আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে।
তাই আমরা যারা চাঁদের অদেখা দিককে Dark Side বলি, তা ভুল।
সাল ১৯৫৯, সোভিয়েত Luna 3 প্রথম ছবি তোলে Far Side এর।
ছবিগুলো ছিল যথেষ্ঠ ঝাপসা, কিন্তু তবুও স্পষ্ট বোঝা যায়,
চাঁদের অদেখা সাইড কিন্তু আমাদের দেখা সাইডের মত নয়।
NASA Lunar Reconnaissance Orbiter(LRO) ২০০৯ সাল থেকে এখনও
ঘুরছে চাঁদের চারপাশে।
উচ্চ রেজোলিউশনের ছবি ও 3D মানচিত্র বানিয়েছে– পুরো Far Side ম্যাপ করা হয়েছে।
চীনের Chang’e-4 ২০১৯ সালে সরাসরি Far Side এ অবতরণ করে,
যা মানব ইতিহাসে প্রথমবার, এবং সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকা Rover.
২০২৪ সালের মাঝামাঝি বিভিন্ন চাইনিজ স্পেস জার্নাল,
ও স্যাটেলাইট ব্লগে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী– Yutu-2 Rover তখনও সক্রিয় অবস্থায় ছবি পাঠাচ্ছিল।
চীন মহাকাশ সংস্থার দাবী অনুযায়ী বর্তমানেও তথ্য পাঠাচ্ছে Yutu-2 Rover.
২০১৯, ভারতের Chandrayaan-2 চাঁদের কক্ষপথ ঘুরে ম্যাপিং করে।
Orbiter এর Terrain Mapping Camera- এর মাধ্যমে,
Far Side এর টপোগ্রাফি ও খনিজ ডেটা সংগ্রহ করে।
ফলে আমরা সরাসরি দেখতে না পেলেও,
চাঁদের অদেখা দিক যে প্রযুক্তির চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে, বা হচ্ছে, তা সত্যি।
এখন যুক্তি হল– মহাকাশ সংস্থাগুলো বিশ্ববাসীর সামনে যেটুকু প্রকাশ করছে,
আমরা সেটুকুই জানতে পারছি।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, স্পেস ডাটার, র’ফরম্যাট জনগণের কাছে পৌঁছান হচ্ছে না,
ফিল্টার করে কিছু রহস্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
২০০৬ সালে নাসা স্বীকার করে যে, অ্যাপোলো ১১-এর স্লো-স্ক্যান টেলিমেট্রি টেপ হারিয়ে ফেলেছে।
ব্যাখ্যা দেওয়া হয়– পুরনো টেপ পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছিল,
যা অ্যাপোলো ১১-এর কিছু ডাটা হারানোর কারণ বলে নাসার দাবী।
এটাকে বাস্তব সত্যি ভেবেও প্রশ্ন জাগে,
এই ঐতিহাসিক, গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড, এত সহজেই,
অসচেতনতার কারণে হারিয়ে গেল?
নাকি সেখানে এমন কিছু ছিল, যা প্রকাশই করা হয়নি?
ষড়যন্ত্র তত্ত্বকারী, এলিয়েন বিশ্বাসী ইত্যাদি এদের জন্যে কিন্তু এ এক বড় ইন্ধন।
কিন্তু আমার মতন অনেকের মধ্যে আজ কিছু প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করে।
ভয়েজার ১ এর মূল লক্ষ্য–
জুপিটার ও স্যাটার্ন এর ছবি, তথ্য সংগ্রহ করা।
এরপর, এদের গ্র্যাভিটিকে কাজে লাগিয়ে ডিপ স্পেসে পৌঁছে
সেখানের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, কসমিক রে পরিমাপ,
ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্টাডি ইত্যাদি।
ভয়েজার ২ এর মূল লক্ষ্য–
জুপিটার, স্যাটার্ন, ইউরেনাস ও নেপচুনের গ্র্যাভিটিকে কাজে লাগিয়ে,
এমনকি আমাদের সোলার সিস্টেমকে ছাড়িয়ে,
ইন্টারস্টেলার স্পেস-এর একই তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো।
( ৬ বিলিয়ন কিমি দূর থেকে পৃথিবীকে দেখতে লাগছিল একটা উজ্বল,
ছোট্ট নীল বিন্দুর মতন।
৬ বিলিয়ন কিমি দূরত্ব থেকে নেওয়া,
ভয়েজারের তোলা এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম ও শেষ ছবি।
ক্লিক করে পড়ুনঃ সীমাহীন মহাশূন্যের রহস্যময় অন্ধকারে একা যাত্রীঃ ভয়েজার! )
ভয়েজার বাস্তবেই আজ ইন্টারস্টেলার স্পেসে অবস্থান করছে।
ভয়েজার ১ অবস্থান– পৃথিবী থেকে ২৪ বিলিয়ন কিমি দূরে।
ভয়েজার ২ অবস্থান– পৃথিবী থেকে ২০ বিলিয়ন কিমি দূরে।
তবে দূরত্বগুলো প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছে ১৭ ও ১৫ কিমি করে।
আজও পৃথিবীতে ভয়েজার-এর রেডিও সিগন্যাল ধরা হয়,
সেটাকে CGI বানিয়ে পাঠানো যাবে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডিও টেলিস্কোপ একই সিগন্যাল পায়,
শুধু নাসা নয়।
ভয়েজারের পাঠানো তথ্য ব্যবহার করে নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও হয়েছে,
যেমন হেলিওস্ফিয়ার-এর সীমানা নির্ণয়।
CGI হলে তা বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীরা যাচাই করতে পারতেন না।
যদি ভয়েজার পৃথিবী থেকে লঞ্চের সময় চাঁদের খুব কাছাকাছি থেকে ছবি তুলতো,
যেমন কয়েক হাজার কিলোমিটার, তখন Far Side এর বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য দেখা যেত।
পাহাড়, গর্ত এবং বেস বা কৃত্রিম অবকাঠামো (যদি থাকে) প্রভৃতি।
ভয়েজারের ক্যামেরা মূলত আউটার প্ল্যানেটস এর জন্যে ক্যালিব্রেট করা হয়েছিল।
চাঁদের কাছে থাকলেও ছবিতে শক্তিশালী ডিটেইল (যেমন অল্প বড় গর্ত বা ক্ষুদ্র ভূ-আকৃতি),
বেশ কিছুটা ঝাপসা হতে পারতো।
কিন্তু বড় বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে ছবিতে বিশেষ অসুবিধা হত না,
সেক্ষেত্রে রহস্যময় কিছু ধরা পড়লেও পড়তে পারতো।
ভয়েজার তখন চাঁদ মিস করে হাই ট্র্যাজেকটোরি
(এমন এক মহাকাশপথ, যা কোনো গ্রহ, উপগ্রহের কক্ষপথ স্পর্শ না করে,
সোজা দ্রতগতিতে উপরের স্তর দিয়ে চলে যায়)-তে চলছিল।
যে কারণে কক্ষপথে বা কাছাকাছি অবস্থান ছিল না।
ভয়েজারের গন্তব্য শুরু থেকেই অন্য দিকে নির্ধারিত ছিল।
অর্থাৎ, ট্র্যাজেকটোরি চাঁদের দিকে, বা কক্ষপথে তৈরি করা হয়নি।
চাঁদের Far Side-এ গোপন ঘাঁটির আপাতত কোনো স্ট্রং এভিডেন্স নেই।
তবে ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ানো কিছু ভিডিও ফুটেজ বা তথ্য যে,
সবটাই ভুল, তা বলাও মুশকিল।
নাসা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, ভারত, চীন,
সবার মিশনেই দেখা গেছে, চাঁদের Far Side- এ শুধু গর্ত, পর্বত, পাহাড়, পাথর, এইসব।
তবে রহস্যময় কিছু কেটে বাদ দেওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
Far Side- এ অবতরণ করা প্রযুক্তিগতভাবে বেশ কঠিন,
কারণ– পৃথিবী থেকে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব নয়, চাঁদ রেডিও সিগন্যাল ব্লক করে, Terrain এবং Navigation Challenge ও সেখানে দাঁড়ায় বড় হয়ে।
সেক্ষেত্রে চাঁদ নিজেই একটা বিশাল দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়,
আর পৃথিবী থেকে পাঠানো বা আসা সব রেডিও তরঙ্গ আটকে দেয়।
রেডিও সিগন্যাল চলে সোজা পথে, বাঁক নেয় না।
এক্ষেত্রে দরকার হয় রিলে স্যাটেলাইট-এর, যা ঘোরে চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝামাঝি কোণে।
China’s Chang’e মিশন এর ক্ষেত্রেও অবলম্বন করা হয়েছিল,
এমন এক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি।
নাসা চাইলেই China’s Chang’e মিশন এর আগে Far Side এ অবতরণ করতে হয়ত পারতো,
কিন্তু তাঁরা তাঁদের বাজেট ব্যবহার করেছে অন্য মিশনে( Mars Rover,
Saturn, Outer Plants).
অ্যাপোলো মিশনের ফটোগ্রাফিক সরঞ্জাম, ফিল্ম, ক্যামেরার স্পেস রেডিয়েশন টেস্ট–
সব নথিভুক্ত।
লুনার লেজার রিফ্লেকটর (অ্যাপোলো নভোচারীরা রেখে এসেছেন)–
আজও, পৃথিবী থেকে লেজার পাঠিয়ে, সে আয়না থেকে প্রতিফলিত রশ্মি মাপা হয়।
অ্যাপোলো ল্যান্ডিংয়ের স্থানটা ভারতের চন্দ্রযান ২ ও নাসার এল আর ও,
স্পষ্টভাবে ছবিতে ধারণ করেছে।
সেখানে নভোচারীদের পদচিহ্ন ও যানবাহনের ছবিও আছে।
স্টুডিও হলে আজও চাঁদের লেজার রিফ্লেকটর কাজ করতো না।
বৈজ্ঞানিক ক্যামেরা অনেক সময়ে ‘গ্রেস্কেল’ (সাদা-কালো) সেন্সর ব্যবহার করে।
কারণঃ সাদা-কালো সেন্সর, রঙিন সেন্সরের থেকে বেশি সংবেদনশীল।
অল্প আলোতেও পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়।
বেশি বিস্তারিত ও কনট্রাস্ট দেখা যায়।
মহাকাশে আলো খুব কম, তাই রঙের চেয়ে স্পষ্টতা বেশি জরুরী।
অনেক সময় রঙিন ছবি বানানো হয় আলাদা আলাদা ফিল্টার ব্যবহার করে।
যেমনঃ লাল, সবুজ, নীল (RGB) ফিল্টার দিয়ে তিনবার ছবি তুলে,
পরে কম্পিউটারে মিশিয়ে রঙিন বানানো হয়।
কিন্তু ডাটা পাঠাতে খরচ বেশি, তাই নাসা অনেক সময় শুধু একটা গ্রেস্কেল চ্যানেল পাঠায়।
বিজ্ঞানীদের জন্যে রঙ গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ভূতাত্ত্বিক গঠন বেশি জরুরী।
রঙিন ছবি সাধারণত জনসাধারণের জন্যে পরে বানানো হয়।
কিছু ক্যামেরা– লুনার অরবিটার (১৯৬০ এর দশক) বা এল আর ও-এর কিছু যন্ত্র।
এত কিছুর পরেও যেন সন্দেহ থেকেই যায় যে–
কিছু কি তবে লুকানো হচ্ছে বিশ্ববাসীর থেকে?
মানবতার মন্দিরে ধর্ম এক সুর সে মানুষ হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, কিংবা হোক বৌদ্ধ, জৈন…
হারানো সভ্যতার নিঃশ্বাস ঘন জঙ্গলের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পাথরের দেয়াল; লতা-গুল্ম যেন সময়ের…
রাজনীতি এখন ধর্ম নয়, রক্তচাপ মানুষ এখন শুধু ভোটে রাজনীতি করে না– রাগে, ভালোবাসায়, ঘুমে,…
ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের খাঁড়ায় বিশ্বাস ও অস্থিরতা মানুষের মন বহুবার একই জায়গায় এসে…
পৃথিবীঃ এক ঘূর্ণনশীল অবিরাম রহস্যের জন্মভূমি পৃথিবী আমাদের জন্মভূমি, এক অবিরাম রহস্যের ঘূর্ণায়মান গ্রহ। আমরা…