ইন্টারনেটের সারফেস ওয়েব (Surface Web)
আমরা প্রতিদিন যে ইন্টারনেট দেখি, ব্যবহার করি–
গুগুলে সার্চ, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে সময় কাটানো, বা ইউটিউব ভিডিও,
কিংবা অনলাইন খবর পড়া ইত্যাদি, তা কিন্তু ইন্টারনেটের এক “দৃশ্যমান অংশ।”
একে বলা হয় ” সারফেস ওয়েব (Surface Web) বা ওপেন ওয়েব (Open Web).
সাধারণত আমরা ধারণাই করতে পারি না যে–
এই সারফেস ওয়েবের মত উন্মুক্ত দুনিয়ার আড়ালে,
অন্ধকারে ঠিক কি কি ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ প্রতিদিন চলে।
সারফেস ওয়েবের প্রত্যেকটা তথ্য আপনি সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাবেন।
শুধু “ক্লিক,” খুলে গেল দরজা, অর্থাৎ ইন্টারনেটের এই জগতের দরজা সবার জন্যে খোলা।
কিন্তু আরও গভীরে দরজা থাকে একবারেই শক্তভাবে বন্ধ,
যেন কোনো “টুঁ” শব্দটাও পাওয়া কঠিন।
ইন্টারনেটের ডিপ ওয়েব (Deep Web)
এই জগতের আড়ালেই রয়েছে এক বিশাল, অদেখা মহাবিশ্ব– “ডিপ ওয়েব।”
এখানে এমন সব তথ্য জমা থাকে, যেগুলো সার্চ ইঞ্জিনের দৃষ্টিসীমার বাইরে।
আপনি সাধারণভাবে সার্চ করেও এসব তথ্য পাবেন না।
এই জগতে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে, আমাকে নিতে হবে বিশেষ অনুমতি, বা লগ ইন।
বিভিন্ন ব্যাঙ্কের অনলাইন পোর্টাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণামূলক ডাটাবেস,
সরকারি নথি, কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত ইমেল ইনবক্স, সব রাখা থাকে এখানেই।
এগুলো অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় হলেও, অবৈধ, অনিরাপদ নয়।
এখানেই সংরক্ষিত থাকে আধুনিক সমাজের অমূল্য সব তথ্যভাণ্ডার।
( কোলা গর্তের গভীরে শোনা গিয়েছিল এক ভৌতিক শব্দ।
কেউ বলেছিল– “এ এক নরকের চিৎকার।”
এখানে তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
পাথরও এখানে তরল হয়ে ধীরে ধীরে স্রোতের মত বয়ে চলে,
যেন আগুনের অত্যন্ত অনুগত।
পড়ুন– Click: আমাদের পায়ের তলায় আগুনঃ জ্বলছে এক রহস্যঘন পৃথিবী! )
ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েব (Dark Web)
ডার্ক ওয়েব রহস্য ও ব্যবহার
ডিপ ওয়েবের অদৃশ্য স্তরের মধ্যে যে সবচেয়ে গাঢ় ও রহস্যময় অধ্যায় থাকে,
তা হল “ডার্ক ওয়েব।”
এখানে কোনো সাধারণ ব্রাউজার ব্যবহার করে,
আপনি কিছু সার্চ করতে পারবেন না।
এই জগতে প্রবেশ করতে গেলে প্রয়োজন,
বিশেষ এক সফটওয়্যার-এর– Tor (The Onion Router).
এই Tor- এর ব্যবহারকারীর পরিচয়, অবস্থান স্বাভাবিকভাবে গোপন রেখে দেয়,
ফলে কে এই Tor ব্যবহার করে, কোন ওয়েবসাইটে ঢুকছে,
কখন বের হচ্ছে, কি সার্চ করছে,
এসব গতিবিধি সাধারণভাবে কিছুই জানার কোনো উপায় নেই।
সারফেস ওয়েবে যেমন আমরা– .com, .org, .in এমন এক্সটেনশন ব্যবহার করি,
কিন্তু এখানে তা চলবে না।
ডার্ক ওয়েবের ওয়েবসাইটগুলোর ঠিকানা সাধারণ ওয়েবসাইটের মত নয়,
এগুলো শেষ হয়– .onion এক্সটেনশনে, যা হল Tor-এর স্পেশাল ঠিকানা,
আর শুধুমাত্র Tor ব্রাউজার থেকেই তা অ্যাক্সেস করা যাবে।
অনেকেই “ডিপ ওয়েব” ও “ডার্ক ওয়েব” শব্দদুটোকে একসাথে ব্যবহার করেন,
কিন্তু বাস্তবে এরা একেবারেই আলাদা।
“ডিপ ওয়েব” এক নিরাপদ ও বৈধ তথ্যের ঘর, আর “ডার্ক ওয়েব” হল,
সেই ঘরের অন্ধকার বেসমেন্ট, যেখানে আলো প্রায় নেই, নজরদারি প্রায় নেই।
এ কারণেই এই অন্ধকারে জন্ম নেয় নানান ধরণের অপরাধ।
ডার্ক ওয়েবে কি কি পাওয়া যায়?
ডার্ক ওয়েবে বিভিন্ন ধরণের কন্টেন্ট এবং পরিষেবা থাকে,
যার মধ্যে কিছু বৈধ হলেও বেশিরভাগটাই অবৈধ ও অনিরাপদ।
অবৈধ বাজারপ্লেস
মাদক, অস্ত্র, চোরাই পণ্য, হ্যাকিং টুলস, এমনকি “কন্ট্রাক্ট কিলার”ও পাওয়া যায়।
তবে ডার্ক ওয়েবে এই ধরণের “ঘাতক ভাড়া” (হিট অর্ডার) নামে বিজ্ঞাপনও দেখা যায়।
এর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনই এক একটা ফাঁদ, বা স্ক্যাম।
কিছু সমীক্ষা ও মামলার রিপোর্টে দেখা গেছে, এমন বিজ্ঞাপন আইনি তৎপরতায় ধরা পড়েছে।
চুরি করা তথ্য
হ্যাক করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য,
বা ব্যক্তিগত তথ্যের ডেটাবেস।
নকল ও অবৈধ কনটেন্ট
নকল ওষুধ, নকল সার্টিফিকেট, এমনকি অবৈধ ছবি বা ভিডিও।
হ্যাকিং ও সাইবার পরিসেবা
DDoS আক্রমণ, ম্যালওয়্যার তৈরি, হ্যাকিং সার্ভিস,
ইত্যাদি ভাড়া দেওয়া হয় আবার প্রয়োজনে বিক্রিও করা হয়।
গোপন যোগাযোগ ও রাজনৈতিক আন্দোলন
কিছু সময় এখানে সাংবাদিক, নীরব প্রতিবাদকারী,
বা মানবাধিকার কর্মীরা নিরাপদে যোগাযোগ করেন।
তবে ষড়যন্ত্রও অবাধে হয় এ স্থানে, যেমন–
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা কর্পোরেট ষড়যন্ত্র,
সাইবার ক্রাইম ষড়যন্ত্র, জঙ্গি বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র।
এই বৈচিত্র্যই ডার্ক ওয়েবকে রহস্যময় করে তুলেছে, আর ঠিক এই কারণেই,
আজও অনেকের জন্যে ডার্ক ওয়েব এক রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু।
অনেকে এখানে প্রবেশ করে বৈধ তথ্য খোঁজে, প্রয়োজন মেটায়,
আবার অনেকেই জড়িয়ে পড়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমে।
ডার্ক ওয়েব কেন বিপজ্জনক?
ডার্ক ওয়েবে বিপদ আসে সাধারণত দুটো দিক থেকেঃ
- ১. আইনগত ঝুঁকি– এখানে অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত হওয়া মানে আইনভঙ্গ করা।
হ্যাক করা তথ্য ব্যবহার করা, অবৈধ জিনিস কেনা-বেচা, এ সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। - ২. ব্যক্তিগত নিরাপত্তা– ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করলে, ম্যালওয়্যার, ট্র্যাকিং বা স্প্যামে ফাঁসার ঝুঁকি থাকে।
অপরিচিত কেউ সহজেই তথ্য চুরি করে নিতে পারে।
তবে কিছু ব্যবহারকারী, বিশেষ করে সাংবাদিক, নীরব প্রতিবাদকারী বা তথ্য সংগ্রাহকরা,
ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে নিরাপদ যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহের জন্য।
যেমন দেশীয় সেন্সরশিপের কারণে কোনো সংবাদ কিংবা তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব না হলে,
তাঁরা Tor বা অন্য কোনো নিরাপদ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন।
ডার্ক ওয়েবের ইতিহাস
ডার্ক ওয়েবের জন্ম মূলত প্রাইভেসি ও নিরাপত্তার বিশেষ চাহিদা থেকেই।
২০০০ সালের দিকে মার্কিন নেভি গবেষকরা Tor প্রকল্প চালু করেন।
মূল উদ্দেশ্য ছিল–
সেনাবাহিনী ও সাংবাদিকদের গোপন যোগাযোগের একটা রাস্তা বানিয়ে দেওয়া,
বা সুযোগ করে দেওয়া।
যাতে কেউ চাইলেই তাঁদের ট্র্যাক করতে না পারে, কিন্তু প্রাইভেসি সুরক্ষার এই প্রযুক্তি,
ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় বিভিন্ন ধরণের মানুষের হাতে।
ফলে যা হওয়ার, হয়েছে ঠিক সেটাই– কেউ নিরাপদ, নিরাপত্তার জন্যে ব্যবহার করে,
তো কেউ আবার ব্যবহার করে ক্রাইম করার জন্যে।
মানুষের কৌতুহল ও আকর্ষণ
ডার্ক ওয়েব কেবল অবৈধ কাজের জায়গাই নয়,
এটা আজ মানুষের কৌতুহল এবং রহস্য খোঁজার প্রবণতার এক প্রতিফলনও বটে।
এটা দেখায় যে, মানুষ প্রাইভেসি কতটা মূল্যায়ন করে।
আজ যেন এই প্ল্যাটফর্ম একদিকে স্বাধীনতার প্রতীক, তো অন্যদিকে অপরাধের আঁতুড়ঘর।
অনেক মানুষই চুড়ান্ত কৌতুহলবশতঃ আজ এখানে প্রবেশ করতে চায়,
শুধু এগুলো দেখার বা জানার জন্যে–
- কি চলছে?
- কেমন চলছে?
- বাজার কেমন?
- নতুন কি এল? ইত্যাদি।
এটা একদিকে যেমন অভিজ্ঞতা, জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে, কৌতুহলকে আরও শক্তিশালী করে,
উল্টোদিকে আবার ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলে অনিরাপদ প্রবেশ,
বা অবৈধ কাজ-কারবারে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিকেও, কিছুটা আসক্তির মত।
আইন ও নিয়ন্ত্রণ
বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ডার্ক ওয়েব মনিটরিং করে।
সরকার, আই টি নিরাপত্তা সংস্থা এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট নিয়মিত ডার্ক ওয়েব ট্র্যাকিং করে,
অপরাধ ঠেকাবার জন্য।
Tor গোপনীয়তা বেশি দিলেও, ব্যবহারকারী বা অপরাধীর ভুল অদৃশ্য করে না।
ট্র্যাক করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
হ্যাক করা তথ্য, অস্ত্র, মাদক বা চাইল্ড এক্সপ্লইটেশন ম্যাটেরিয়ালস বা চাইল্ড অ্যাবিউস ছবি,
ভিডিও কেনা-বেচা, শেয়ার করা, এর বিরুদ্ধে কড়া আইন আছে।
যেহেতু এটা মূলত অদৃশ্য, তাই প্রযুক্তি ও আইন মিলে একসাথে এর বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়,
যেখানে নৈতিকতার ভারসাম্য বজায় রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
চাইল্ড এক্সপ্লইটেশন ম্যাটেরিয়ালস বা চাইল্ড অ্যাবিউস ছবি,
ভিডিও কেনা-বেচা, শেয়ার করা বা রাখা বিশ্বের সব দেশে আজ গুরুতর অপরাধ।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যেমন– ইন্টারপোল, ইউরোপোল, এফ বি আই,
ডার্ক ওয়েবের এই নেটওয়ার্কগুলো শনাক্ত করে বিশেষ অপারেশন চালায়।
ইন্টারনেটের এই জগৎ আমাদের যেন মনে করিয়ে দেয়–
“প্রযুক্তি তোমাদের জন্যে খোলা, এর ব্যবহার কিভাবে করবে?
তা নির্ভর করে তোমাদের উপর।
এর ভালো খারাপ, দু দিকই আছে, ভালো করলে, ভালো।
আর খারাপের পরিণাম ভয়ঙ্কর!”
ডার্ক ওয়েব এটাও জানায়, প্রযুক্তি স্বাধীনতা দিতে পারে,
কিন্তু সতর্কতা ছাড়া আনতে পারে বিপদ ডেকেও।

( এদিকে ভারতে– সরকার যেই পাল্টালো, বদলে গেল নীতি।
যা দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে ভালো, এগিয়ে নিয়ে যাবে রাষ্ট্রকে,
তা গ্রহণ করা যে কোনও সরকারের পক্ষেই উচিৎ।
পড়ুন– Click: আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপঃ ভারত কি পেতে চায়? )
(বিঃ দ্রঃ যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে–
“কনট্রাক্ট কিলিং” আয়োজন করা কঠোর অপরাধ।
ডার্ক ওয়েবে এ ধরণের অফার বা গতিবিধি দেখলে, প্রমাণ সংরক্ষণ করুন।
সাথে সাথে যোগাযোগ করুন স্থানীয় পুলিশ স্টেশন বা সাইবার ক্রাইম ইউনিটে।
বিতর্কিত লিঙ্ক কিংবা বিজ্ঞাপনের সাথে জড়িত থাকা,
এমনকি আপনাকেও ফেলতে পারে গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে।)
Articlesবাংলা Bangla Articles, Quotes & Prose-Poetry / বাংলা প্রবন্ধ, উক্তি ও গদ্য-কবিতা।


