রাজনীতি এখন ধর্ম নয়, রক্তচাপ
মানুষ এখন শুধু ভোটে রাজনীতি করে না–
রাগে, ভালোবাসায়, ঘুমে, খাবারে– সব জায়গায়।
যেভাবে বাতাসে ধুলো থাকে,
ঠিক তেমনই প্রতিটা চিন্তায় রাজনৈতিক কণা ভাসে।
কোনও কথা বললে আগে শিরোনাম হয়– “আপনি ওঁদের?”
বেঁচে থাকা এখন একটা ডিক্লারেশন ফর্ম।

আর এই অদ্ভুত যুগে ঈশ্বরও যেন এক অজানা চাপের মুখে।
তাঁর নামও এখন ব্যবহার হচ্ছে ম্যানিফেস্টো, এমনকি মিমে!
এক দল বলে, “আমাদের ঈশ্বর সবচেয়ে দেশপ্রেমিক।”
অন্য দল বলে, “আমাদের ঈশ্বর বেশি মানবিক।”
মাঝখানে ঈশ্বর হয়তো ফেসবুকে বসে ভাবছেন–
“আমার কি এখনও নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব?”
ঈশ্বরেরও এখন দলীয় হুইপ
রাজনীতির এই প্রভাব এখন স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আগে মানুষ মন্দিরে গিয়ে বলত–
“হে প্রভু, আমার পাপ ক্ষমা করো।”
এখন বলে–
“হে প্রভু, ওদের একটু শিক্ষা দাও।”
প্রার্থনা নয়, যেন পার্টির মেমো জমা দিচ্ছে কেউ।
ঈশ্বর এখন যেভাবে ডাক পান,
তাতে মনে হয় তিনিও হাইকম্যান্ডের সদস্য।
এক পাড়ায় শুনি–
“আমাদের ঈশ্বর সংস্কৃতিমনস্ক,
তিনি রেলওয়ে ডেভেলপমেন্টে আছেন।”
অন্য পাড়ায় বলে–
“না, আমাদের ঈশ্বর সর্বহারা আন্দোলনের বন্ধু।”
এমনকি কেউ কেউ আবার বলছেন–
“ঈশ্বর আসলে বিরোধী দলীয় নেতা,
ওনার কথাই কেউ শুনছে না।”
( জুবিন গর্গ-এর মতন একজন মানুষ–
পেলেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু–
আকস্মিক, মর্মান্তিক ও অনিচ্ছাকৃত বিদায়।
আর– অভয়াদের হত্যাকারী আর নেপথ্যের সেই মাস্টারমাইন্ডরা,
আজও জীবন কাটাচ্ছে নিশ্চিন্তে।
পড়ুন– Click: ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের পরীক্ষা! )
ধর্ম নয়, ডেটা যুদ্ধ
আগে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক হতো দর্শনের বইয়ের পাতায়,
এখন হয় ইউটিউব কমেন্ট সেকশনে।
প্রমাণের জায়গা বদলেছে–
আগে ছিল মন, এখন অ্যালগরিদম।
কারও কাছে ঈশ্বর ট্রেন্ডিং টপিক,
কারও কাছে ক্লিকবেইট।
যে যত বেশি “শেয়ার” পায়, সে ততটাই ধার্মিক।
রাজনীতির প্রভাব এমনই গভীর যে,
ভক্তিও এখন স্পনসরড কনটেন্ট।
মানুষ এখন ঈশ্বরের নামে প্রার্থনা কম, পোস্ট বেশি করে।
আর লাইক সংখ্যা দেখে ঈশ্বরও হয়তো ভাবছেন–
“এই যুগে আমার অলৌকিক শক্তিও মার্কেটিং-এর উপর নির্ভরশীল।”
আর এই প্রভাব শুধু মন্দির-মসজিদ বা মনের ভিতরেই নয়,
পৌঁছে গেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক ছোট্ট কোণে।
মতামতের বাজের ঈশ্বরের দর
মানুষ আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে,
যেখানে সত্যি বলাও একধরণের রাজনৈতিক ঝুঁকি।
তুমি বললে, “মানবতা দরকার”,
তখনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হবে ইটের মতো,
“কার মানবতা? ডান, না বামের?”
এই বিভাজনের যুগে ঈশ্বরও দিক হারিয়েছেন।
তিনি এখন কারও কাছে “জাতির প্রতীক”,
কারও কাছে “অপপ্রচার”,
আবার কারও কাছে শুধুই “মিম ম্যাটেরিয়াল।”
এমনকি এক ধর্মপ্রাণ যুবক একদিন লিখলো–
“আমি ঈশ্বরকে ভোট দিচ্ছি।”
কমেন্টে কেউ লিখলো–
“ভাই, উনি তো আগেই নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা হয়েছেন।”

ঈশ্বরের নির্বাচন কমিশন
একটা সময় ছিল, মানুষ ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখত,
আর আজ ঈশ্বরকে নিয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা জরিপ’ হয়।
কে বেশি শান্তি দিয়েছেন, কে বেশি বৃষ্টি নামিয়েছেন–
এ নিয়ে ডেটা অ্যানালিটিক্স চলছে!
একজন বললেন,
“আমাদের ঈশ্বর ৭২% জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে।”
অন্যজন প্রত্যুত্তর করে বসলেন–
“তোমাদের ঈশ্বর তো ই.ডি তদন্তে আছে।”
রাজনীতির এই চমৎকার কারিগরি দেখে মনে হয়,
ঈশ্বরও হয়তো এখন একটা রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি টিম গঠন করেছেন–
স্লোগানঃ “বিশ্বাস ফেরাও, ভোট নয়!”
ঈশ্বরের মিরর টেস্ট
মানুষ ঈশ্বরকে খুঁজতে গিয়ে আসলে নিজের প্রতিচ্ছবি বানিয়ে ফেলেছে।
যে যেমন, তাঁর ঈশ্বরও তেমন।
লোভীর ঈশ্বর ধনী,
রাগীর ঈশ্বর যুদ্ধবাজ,
ভীতুর ঈশ্বর সবসময় ক্ষমতার ছায়ায় থাকেন।
আর রাজনীতিবিদের ঈশ্বর পার্টি অফিসে থাকেন।
ফলত, মানুষ এখন ঈশ্বরকে দেখে না–
নিজের মতামতের ছায়া দেখে।
যেদিন কেউ বলবে,
“ঈশ্বর নিরপেক্ষ”,
সেদিনই কেউ চিৎকার করবে–
“এই বক্তব্য কোন পার্টির হয়ে?”
এমন এক পৃথিবীতে ঈশ্বরও হয়তো বলবেন–
“আমাকেও নির্দল প্রার্থী থাকতে দাও!”
ঈশ্বর লাইভে আছেন
এখন ঈশ্বরকে দেখা যায়,
টকশোতে, মিমে, প্যানেল আলোচনায়,
আর অবশ্যই ভোটের আগে প্রতিটা ব্যানারে।
সবাই তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি বানাতে চায়।
একদল বলে,
“ঈশ্বর আমাদের সাথেই।”
অন্য দল বলে,
“তোমাদের ঈশ্বরও আগে আমাদের পার্টিতে ছিলেন।”
এভাবেই ঈশ্বর এখন জড়িয়ে গেছেন,
ভোটের গাণিতিক সমীকরণে।
একজন বৃদ্ধ তো হেসেই বললেন–
“আগে পাপ করলে ঈশ্বর বিচার দিতেন,
এখন তিনি নিজেই কমিশনে হাজিরা দিচ্ছেন!”
নীরব ঈশ্বর,
কথাবার্তায় ব্যস্ত মানুষ
সবচেয়ে করুণ দিক হল,
মানুষ এখন ঈশ্বরের হয়ে কথা বলে,
কিন্তু ঈশ্বরের কথা শোনে না।
যিনি প্রেমের শিক্ষা দিয়েছিলেন,
তাঁর নামে ঘৃণা ছড়ানো এখন একধরণের পেশা।
যিনি ন্যায় বলেছিলেন,
তাঁর নামে অশান্তি ছড়ানো এখন নীতি।
হয়তো ঈশ্বর নীরব থেকে দেখছেন,
মানুষের ভিতরের রাজনীতিই নতুন ধর্ম হয়ে উঠেছে।
যেখানে প্রার্থনায় জায়গায় এখন বিতর্ক,
আর আশীর্বাদের জায়গায় “বাইট।”
ঈশ্বরের প্রেস কনফারেন্স
ভাবো, যদি ঈশ্বর একদিন হঠাৎ প্রেস কনফারেন্স ডাকেন,
“দেখো ভাই, আমি নির্দল।
আমার কোনও দলীয় অফিস নেই,
আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে মানুষ রাখা।
তোমরা এখন আমাকে ব্যবহার করছো,
যেভাবে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করো,
কাজ শেষ, মানে ভুলে যাও।”
সংবাদমাধ্যমে তখন হেডলাইন হবে–
“ঈশ্বরের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক।”
বিশ্বাসের রঙ
আজকাল ঈশ্বরের মুখেও রঙ লেগে গেছে,
কেউ তাঁকে গেরুয়া করে,
কেউ লাল করা, আবার কেউ সবুজ করে।
রঙের এই রাজনীতিতে আসল বিশ্বাসটাই ম্লান হয়ে গেছে।
মানুষ ভাবছে, ঈশ্বর মানেই আমাদের,
কিন্তু কেউ বুঝছে না, ঈশ্বর যদি সত্যিই থাকেন,
তবে তিনি ‘আমাদের’ বা ‘ওদের’ নন।
তিনি সেই জায়গার বাসিন্দা, যেখানে কোনও পতাকা ওড়ে না।
ঈশ্বরের ভোটার তালিকা
যদি সত্যিই ঈশ্বর ভোটার তালিকা করতেন,
তবে হয়তো প্রথমেই বাদ যেত, যারা ভক্তির নামে ঘৃণা করে,
যারা সত্যের নামে মিথ্যা প্রচার করে,
যারা মানবতার বদলে স্লোগানে বাঁচে।
আর অন্তর্ভুক্ত হতো–
যে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চায়,
যে শিশুর ক্ষুধা দেখে ব্যথা পায়,
যে অন্যের বিশ্বাসে হেসে ওঠে না, বরং বোঝে।
শেষ কথাঃ
ঈশ্বর এখনও নিরপেক্ষ আছেন কি না
সম্ভবত ঈশ্বর এখনও নিরপেক্ষ,
কিন্তু তাঁর ভক্তরা নয়।
মানুষ নিজের রাগ, ভয় আর লোভ দিয়ে ঈশ্বরের মুখ ঢেকে দিয়েছে।
এখন ঈশ্বর দেখা দেন শুধু তখন,
যখন কেউ নিঃশব্দে ভালো কাজ করে,
কাউকে ছোট না করে, কারও বিপদে পাশে দাঁড়ায়।
বাকি সবই–
পোস্টার, বক্তৃতা, আর কাগজে ছাপা মতামত।
অর্থাৎ, মানুষ আজ ঈশ্বরকেও ভোটে নামিয়ে দিয়েছে,
আর ঈশ্বর হয়তো আকাশের কোণে দাঁড়িয়ে হাসছেন–
“আমি কি সত্যিই এখনও প্রার্থী?”
শেষে একটাই প্রশ্ন রয়ে যায়ঃ
যখন মানুষ রাজনীতির বাইরে ঈশ্বরকে খুঁজবে না,
তখন ঈশ্বরও হয়তো বলবেন–
“তোমরা আমাকে ভোটে জিতিয়েছ,
কিন্তু বিশ্বাসে হারিয়েছ।”
বিঃ দ্রঃ
- এই ব্লগে প্রকাশিত লেখা শুধুমাত্র বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে লেখা।
- ধর্ম বা কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ,
বা অবমাননা করা এই ব্লগ সমর্থন করে না। - এখানে দেওয়া তথ্য ও উদাহরণগুলো পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে নির্বাচিত;
এগুলোকে সত্য বা সমর্থনের স্বরূপ হিসেবে গ্রহণ করা উচিৎ নয়।
( চারিদিক জুড়ে এক মহাশূন্যতা,
ও হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস যেন এর অহঙ্কারের সীমা ছুঁয়েছে।
যেখানে কোনও পতাকা, কোনও রাষ্ট্র, কোনও নাম নেই।
পড়ুন– Click: ডিজিটাল ভ্রমণ– রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা পৃথিবী! )
Articlesবাংলা Bangla Articles, Quotes & Prose-Poetry / বাংলা প্রবন্ধ, উক্তি ও গদ্য-কবিতা।



