হারানো সভ্যতার নিঃশ্বাস
ঘন জঙ্গলের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পাথরের দেয়াল;
লতা-গুল্ম যেন সময়ের ধুলো মুছে দিতে চায় তার বুকে।
সূর্যের আলোকরশ্মি ভেদ করে নেমে আসে এক বিশালদেহী পিরামিডের চূড়ায়।
আলো ছুঁয়ে যায় ইতিহাসের ঘুমন্ত মুখ।
এ কোনো মৃত সভ্যতার অলৌকিক দৃশ্য নয়,
বরং এক নিঃশব্দ নিঃশ্বাস, যেখানে সময় কিছু জায়গায় এখনও থমকে আছে।
সেই নীরবতার মধ্যেই,
অরণ্যের কোলে একসময় জেগে উঠেছিল “মায়ান সভ্যতা,”
যাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও ধর্মের রহস্য,
আজও আধুনিক মানুষকে হতবাক করে দেয়।

কিন্তু তারপর…
একদিন, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি,
আঙুলের ছোঁয়ায় সমস্ত জীবন, শব্দ, আলো, সবকিছু মুছে দিল এক মুহূর্তে।
শুধু রয়ে গেল ধ্বংসস্তূপ, আর এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন–
কোথায় হারিয়ে গেল তারা?
অরণ্যের কোলে সভ্যতার জন্ম
মধ্য আমেরিকার ঘন অরণ্য ও নদীবিধৌত উপত্যকায় জন্ম নেয় মায়ান সভ্যতা।
আজকের মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, বেলিজ,
হুনডুরাস ও এল সালভাদর অঞ্চল ছিল তাদের প্রধান বাসভূমি।
এই সভ্যতার সূচনা ঘটে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে।
তাদের নগরজীবনের স্বর্ণযুগ ছিল খ্রিস্টীয় ২৫০ থেকে ৯০০ সালের মধ্যে,
যাকে ‘ক্লাসিকাল যুগ’ বলা হয়।
অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল,
মায়ান সভ্যতার ‘প্রাক ক্লাসিক যুগ’,
যা পরবর্তীতে তাদের সভ্যতার ভিত্তি গড়ে দেয়।
কৃষিই ছিল তাদের অর্থ-সমাজের মেরুদণ্ড।
ভুট্টা, মটরশুঁটি, কুমড়ো ও মরিচ ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ।
তাদের ধর্মে ভুট্টা ছিল দেবতা, সূর্য ছিল জীবনদাতা।
এই প্রকৃতিনির্ভর জীবন থেকেই জন্ম নেয় তাদের প্রথম নগর–
টিকাল, পালেনকে, কোপান, চিচেন ইতজা,
যেগুলোর ধ্বংসাবশেষ আজও ঘন জঙ্গলের ভিতর,
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের একমাত্র সাক্ষী হয়ে।
( ঈশ্বর আছেন, না নেই?
জানুন প্রকৃত সত্য…
পড়ুন– Click: ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের পরীক্ষা! )
আকাশপুত্রদের রাজ্যঃ
জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ক্যালেন্ডার
মায়ানরা শুধু পৃথিবীর মানুষ ছিল না, তারা আকাশের রহস্যের সন্ধানী।
তারা সূর্য ও চাঁদের গতিপথ নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ করত,
এবং তৈরি করেছিল এমন এক ক্যালেন্ডার, যা আজও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে।
- হা’আব (ha’ab) ক্যালেন্ডার–
মায়া ক্যালেন্ডারে ১৮ মাস * ২০ দিন + ৫ অতিরিক্ত দিন (উয়েব),
মোট ৩৬৫ দিন। - টজোল্ক’ইন ক্যালেন্ডার–
২৬০ দিনের ধর্মীয় চক্র, যা ১৩ টা সংখ্যা * ২০ টা নামের চক্রে গঠিত।

এই দুই ক্যালেন্ডার মিলে–
মায়াদের জীবন, উৎসব ও রাজতান্ত্রিক অনুশাসনকে প্রভাবিত করত।
আবার এই দুই ক্যালেন্ডার মিলেই তৈরি হয়েছিল এক বিশাল সময়ের ঘূর্ণি,
যেখানে প্রতিটা দিন ছিল কোনো না কোনো দেবতার অধীনে।
তাদের বিশ্বাস ছিল–
“বিশ্ব সৃষ্টি ও ধ্বংস এক অন্তহীন চক্রের মধ্যে ঘোরে।”
এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই তাদের আকাশের দিকে ঠেলে দেয়।
মায়ানরা জানত তারাদের ভাষা, তারা আকাশকে পড়ত ঠিক বইয়ের মত।
স্থাপত্যে জ্যামিতিক জাদু
মায়া স্থাপত্য শুধু পাথরের খেলা নয়,
তা ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক মিলিত শিল্প।
চিচেন ইটজার ‘এল কাস্তিলো’ পিরামিডে বছরে দু’বার সূর্যের আলো এমনভাবে পড়ত,
যেন বিশাল এক পাইথন সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।
এই ঘটনাটা ছিল তাদের কুকুলকান দেবতার প্রতীকী রূপ,
এক সাপদেহী দেবতা, যিনি আকাশ আর পৃথিবীর মিলনের প্রতীক।
তাদের বিল্ডিং, সিঁড়ি ও প্লাজাগুলোতে জ্যামিতিক অনুসন্ধান স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
এসব নিখুঁত স্থাপত্য প্রমাণ করে– তারা শুধু নির্মাতা ছিল না,
বরং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিখুঁত পরিকল্পক ও ইঞ্জিনিয়ার ছিল।
লিপি ও জ্ঞানের কোডেক্স
মায়ানরা লিখত জটিল চিত্রলিপিতে (Hieroglyphics).
তাদের লেখা ছিল শব্দ, ছবি ও প্রতীকের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
তারা বানিয়েছে কোডেক্স, যেখানে লেখা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান,
ধর্ম, চিকিৎসা ও ইতিহাস।
কিন্তু ষোড়শ শতকে স্প্যানিশ বিজেতারা যখন আসে,
তারা এই জ্ঞানসম্পদকে “অশুভ” ভেবে আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
আজ বেঁচে আছে মাত্র তিনটে মায়ান কোডেক্স–
ড্রেসডেন কোডেক্স, প্যারিস কোডেক্স ও মাদ্রিদ কোডেক্স,
যা যথাক্রমে ড্রেসডেন, প্যারিস ও মাদ্রিদ শহরে অবস্থিত।
চতুর্থটা, ১৯৭০ সালে আবিস্কৃত গ্রোলিয়ের কোডেক্স (Grolier Codex),
যা বিতর্কিত হলেও, বর্তমানে স্বীকৃত।
এগুলো এখন আমাদের জানালার মত,
যেখান দিয়ে আমরা উঁকি দিতে পারি তাদের অদ্ভুত চিন্তার জগতে।
রক্ত, বিশ্বাস ও দেবতার বিচার
মায়ান সমাজের হৃদয়ে ছিল এক তীব্র ধর্মবিশ্বাস।
তারা বিশ্বাস করত, মানব রক্ত দেবতাদের শক্তি জাগিয়ে রাখে।
রাজা ও পুরোহিতরা নিজেদের শরীর কেটে রক্ত বের করত।
কখনও কখনও মানব বলিও দিত উৎসবের সময়, তবে তা প্রধানত যুদ্ধবন্দীদের।
তাদের কাছে মৃত্যু ছিল শেষ নয়, বরং অন্য জগতের পথে যাত্রা।
এই বিশ্বাসের মধ্যে যেমন ভয় ছিল, তেমনই ছিল কবিতা,
এক অজানা জগতের প্রতি অদম্য শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ।
পতনের ধাঁধাঃ
সভ্যতার অদৃশ্য হওয়া
খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর দিকে,
দক্ষিণ মায়ার নগরগুলো একে একে জনশূন্য হয়ে পড়ে।
অরণ্য দখল করে নেয় মন্দির, নিঃশব্দে থেমে যায় সভ্যতার শ্বাস।
ইতিহাসবিদরা এর পিছনে নানান কারণ দেখান–
- দীর্ঘ খরা ও খাদ্য সংকট।
- অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘর্ষ।
- বন উজাড় ও পরিবেশ ধ্বংস।
- অথবা হয়তো অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরিবর্তন।
কিন্তু সত্যি হল– কেউই এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।
মায়ান সভ্যতা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে ঠিক যেন কোনও গোপন মন্ত্রের মত।
শুধু রেখে গেছে ধ্বংসস্তূপ, প্রতীক আর বিস্ময়কর প্রশ্ন।
তারা আসলেই কি হারিয়ে গেছে?
না, পুরোপুরি নয়।
আজও মধ্য আমেরিকার জঙ্গলে মায়া জাতির উত্তরসূরিরা বেঁচে আছে।
তারা এখনও মায়া ভাষায় কথা বলে।
পুরনো দেবতাদের সম্মান জানায়,
আর প্রাচীন ক্যালেন্ডারের ছায়ায় সময় গোনে।
তারা হয়তো রাজা বা পুরোহিত নয়,
কিন্তু তাদের চোখে এখনও জ্বলজ্বল করে সেই প্রাচীন জ্ঞানের আলো,
যা সময়ের পর্দা ভেদ করে আজও আমাদের দিকে চেয়ে আছে।
সময়ের অরণ্যে এক অমর প্রতিধ্বনি
সময়ের ফিসফিসানি
মায়ান সভ্যতা আমাদের শেখায়,
সভ্যতার মহিমা কেবল প্রযুক্তি বা রাজত্ব নয়,
সভ্যতা হল মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস ও অনুসন্ধানের সাহস।
তারা নক্ষত্রকে পড়েছিল, আকাশ মেপেছিল।
সূর্যের ছায়ার পথ চিহ্নিত করেছিল, জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিল।
তারা পাথরের মধ্যে কাব্য খুঁজেছিল, ধ্বংসস্তুপে গল্প শুনেছিল।
তারা নিঃশব্দে কথা বলত, কিন্তু পৃথিবী শুনত,
কিন্তু তারা নিজেদের পতন বুঝতে পারেনি।
তবু তাদের গল্প আজও বেঁচে আছে–
জঙ্গলের নিস্তব্ধতায়, পাথরের মন্দিরে, আর কৌতুহলের গভীরে।
মায়ান সভ্যতা যেন সময়ের এক অমর প্রতিধ্বনি,
যা মনে করিয়ে দেয়–
“মানুষ বিলীন হয়, কিন্তু জ্ঞান কখনও হারায় না।”
( চলুন ঘুরে আসি গোটা পৃথিবী–
পৃথিবী শুধু ভ্রমণের স্থান নয়, এটা একটা অসীম জ্ঞান,
একটা বিশাল উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা।
পড়ুন– Click: ডিজিটাল ভ্রমণ– রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা পৃথিবী! )
ধ্বংসস্তুপের নিঃশব্দ কাহিনী
আজ ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে অবাধে হাওয়া চলাফেরা করছে।
পাতাগুলো হালকা কাঁপছে,
মনে হয় কেউ বা কিছু আমাদের ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে।
প্রাচীন পাথর, ভাঙা মন্দির, চিরতরে নিঃশব্দ।
কিন্তু সেই নিঃশব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক জীবন্ত ইতিহাস।
ঝোপঝাড়ের মধ্যে হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ।
নাকি মাটি থেকে উঠে এসেছে কোনও অদৃশ্য শক্তি?
প্রতিটা ধ্বংসস্তুপ যেন আমাদের দিকে চোখ রাখছে,
শুনছে, যাচাই করছে–
আমরা কি সত্যিই খুঁজছি, জানতে চাইছি?
প্রাচীন শহরের সড়কগুলো এখন জনশূন্য,
কিন্তু যদি মনোযোগ দিলে অনুভব করা যায়,
সেখানে এক সময় মায়ানরা বসে কথা বলত, গল্প শোনাত,
আচার পালন করতো।
আর এখন, ছায়া আর বাতাস সাক্ষী।

কেউ বলে–
রাতের অন্ধকারে মন্দিরের ভাঙা দেয়ালগুলো ঝলমল করে ওঠে,
যেন তারা এক অজানা আলোর উৎস হতে চায়।
পাথরের স্তর, ভাঙা সিঁড়ি, নীরবতা–
এ সবই এক এক করে আমাদেরকে বলছে,
“আমাদের পথ অনুসরণ করো, আমাদের গল্প শোনো,
আমাদের সাথে হাঁটো।”
(Articlesবাংলা– আমাদের, আপনাদের পরিবার, সাথে যুক্ত থাকুন।
লেখাটা ভালো লাগলে শেয়ার করে বন্ধুদের পড়ার সুযোগ করে দিন।)
Articlesবাংলা Bangla Articles, Quotes & Prose-Poetry / বাংলা প্রবন্ধ, উক্তি ও গদ্য-কবিতা।




