ঈশ্বর আছেন, না নেই?–
ন্যায়ের খাঁড়ায় বিশ্বাস ও অস্থিরতা
মানুষের মন বহুবার একই জায়গায় এসে হাজির হয়–
কেউ এসে বলেন তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, ঈশ্বর আছেন।
আর কেউ যখন নিস্পৃহভাবে সত্য প্রকাশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়,
অপরাধী রয়ে যায়– তখন মনে হয় ঈশ্বর নেই, থাকলে তাঁর সাথে এমনটা হত না।
এই দ্বন্দ্বটা কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়–
এটা দার্শনিক, নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নের প্রাণসঞ্চারক শক্তি।
আজ আমরা যুক্তির আলোয় খোঁজার চেষ্টা করবো–
বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলো কিভাবে,
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নটাকেই জটিল ও বিভ্রান্তিকর করে তোলে।
মানুষ ও ন্যায়বোধের টানাপোড়েন
মানুষের ভিতরেই এক প্রগাঢ় ন্যায়বোধ আছে।
আমরা চাই–
ভালো কাজের উপযুক্ত সম্মান, পুরস্কার মিলুক, খারাপ কাজের শাস্তি হোক।
এই সহজ সূত্রটাই আমাদের বিশ্বাসের মজবুত ভিত।
যখন দেখা যায় এক নির্লোভ, সৎ মানুষ জীবনের শেষ পর্যন্ত,
ন্যায়কে আঁকড়ে রেখেও অপমানিত বা পরাজিত,
তখন স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায় সেই ন্যায়বোধ।
জুবিন গর্গ-এর মতন একজন মানুষ–
যিনি নিজের আর্থিক সাফল্যকে মানুষের উপকারে ব্যয় করতেন।
নিঃসংকোচে মাটিতে পা রেখে দাঁড়াতেন সাধারণ মানুষের পাশে,
নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতেন সমাজের স্বার্থে।
কিন্তু সেই মানুষই পেলেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু–
আকস্মিক, মর্মান্তিক ও অনিচ্ছাকৃত বিদায়।
এই বিদায় না হলে তো নিশ্চই আজও একইভাবে করে যেতেন সমাজের জন্যে।
ভালোবাসার আলো ছড়িয়ে দিতেন জীবনের প্রতিটা কোণে।
তবে কেন?
তাঁর এই হৃদয়বিদারক মৃত্যুর খবর,
আসামসহ প্রতিবেশী দেশের মানুষের বিশ্বাসের ভিতকে যেন নাড়িয়ে দিয়েছে,
কারণ তাঁরা ভাবতে বাধ্য–
যে মানুষ এত ভালো ছিলেন, তাঁর সাথে বিধাতার এ কেমন অন্যায়?
তবে কি সত্যিই ন্যায়ের উপরে ঈশ্বর নীরব?
ন্যায়বিচারহীন পৃথিবী
অভয়াদের হত্যাকারী আর নেপথ্যের সেই মাস্টারমাইন্ডরা,
আজও জীবন কাটাচ্ছে নিশ্চিন্তে।
ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, ক্ষমতার খেলায় মানুষ খুন হচ্ছে প্রতিদিন–
তবু সমাজ ধ্বংসকারীরা অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এই পৃথিবীর বাতাসে,
কোনও অনুতাপ নেই, বিচার নেই, যেন কিছুই কোনও দিন হয়নি।
পাকিস্তানে সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁস হয়ে,
আজও দু’বেলা বিরিয়ানি খাচ্ছে দাউদ ইব্রাহিম,
আর সেখানেও, ঠিক সেই মুহূর্তে ঈশ্বর নীরব।
বড়দের প্রণাম করলে তাঁরা একসময় আশীর্বাদ দিতেন– “দীর্ঘজীবী হও।”
এখন ভাবি, দীর্ঘজীবী হওয়ার সংজ্ঞাটাই বদলে গেছে–
যে যত বেশি চতুর ও নির্মম, দীর্ঘজীবী সে-ই আজ সবচেয়ে বেশি।
এ প্রশ্ন কিন্তু আজ কোনও একক মানুষের নয়–
এটা হাজার বছরের মানব সভ্যতার এক অন্তর্গত বেদনা।
( চারিদিক জুড়ে এক মহাশূন্যতা,
ও হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস যেন এর অহঙ্কারের সীমা ছুঁয়েছে।
প্রকৃতির সর্বোচ্চ শক্তি এখানে প্রতিফলিত,
মানুষের পা এখানে খুব কম পড়ে।
পড়ুন– Click: ডিজিটাল ভ্রমণ– রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা পৃথিবী! )
অন্যায়ের অস্তিত্ব কি
ঈশ্বরের অনুপস্থিতির প্রমাণ?
যদি সত্যিই কোনও সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ও দয়ালু ঈশ্বর থাকেন,
তাহলে তিনি কেন কোনও অন্যায়, নির্যাতন, দুঃখ ও মৃত্যু হতে দেন?
তবে একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়–
এই প্রশ্নটা মানবিক অনুভবের চোখ দিয়ে দেখা, ঈশ্বরের চোখ দিয়ে নয়।
আমরা দেখছি আজ, এই মুহূর্তে; ঈশ্বর– যদি থাকেন, দেখছেন সময়ের সম্পূর্ণ বৃত্ত।
যেমন এক উপন্যাসের চরিত্র তার নিজের পরিণতি জানে না,
কিন্তু লেখক জানেন, গল্প কোথায় গিয়ে শেষ হবে।
তাই আমরা যখন ঈশ্বরের ন্যায়বিচার চাই,
তখন তা মানুষের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করি।
কিন্তু ঈশ্বরের বিচার– যদি তা সত্যিই থাকে,
হতে পারে সময়ের পরিধি পেরিয়ে, আত্মার স্তরে।
তবু এই ব্যাখ্যা আমাদের মনকে পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারে না,
কারণ মানুষ তাৎক্ষণিক ন্যায় চায়, আগামী জন্মের নয়।
স্বাধীন ইচ্ছা–
মানবিক বেদনায় ঈশ্বরের নীরবতা
আরেকটা দার্শনিক যুক্তি বলে– ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন।
তিনি যদি প্রতিটা অপরাধ থামিয়ে দেন, তবে মানুষ আর মানুষ থাকবে না,
হয়ে উঠবে যান্ত্রিক পুতুল।
মানুষের মস্তিষ্ক, নীতি, বিবেক– সবই পরীক্ষা দেয় এই স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে।
ভালো মানুষ অন্যায়ের শিকার হয়, কারণ মন্দদেরও সেই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
এই স্বাধীনতাই নৈতিক জগতের পরীক্ষার ক্ষেত্র।
অর্থাৎ, ঈশ্বর সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও,
তাঁর উদ্দেশ্য মানুষের ভিতরেই এক বিবেক জন্মানো,
যে বিবেক অন্যায়কে ঘৃণা করে, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে।
তবে এও সত্যি, এই তত্ত্ব যতই যুক্তিপূর্ণ শোনাক,
বাস্তবের মর্মান্তিক মুহূর্তে তা হৃদয়কে সান্ত্বনা আদৌ দেয় না।
যখন কোনও নিরপরাধ শিশু খুন হয়, বা কোনও ন্যায়-নীতিবাদী ডাক্তার হত্যা হয়,
তখন তত্ত্ব নয়, প্রয়োজন হয় ন্যায় ও জবাবদিহির–
সেখানেই ঈশ্বরের নীরবতা সবচেয়ে নির্মম মনে হয়।
ঈশ্বর নেই বললে দায় কার উপরে পড়ে?
যদি আমরা বলি, ঈশ্বর নেই–
তবে অন্যায়ের দায় পুরোপুরি আমাদের ঘাড়ে এসেই পড়ে।
তাহলে পৃথিবীতে হওয়া এত অবিচার, দুঃখ, লোভ, লালসা, হত্যা,
এ সব মানুষের সৃষ্ট, এবং শুধুই মানুষকে সেগুলোর পরিণতি সামলাতে হবে।
অর্থাৎ, ঈশ্বর না থাকলেও মানুষকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতেই হবে,
কারণ এতেই টিকে থাকবে সভ্যতা।
এই ভাবনাই মানবতাবাদের মূলঃ ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন,
মানুষকে মানুষ হিসেবে তার দায়িত্ব নিতে হবে।
তাহলে ঈশ্বরের অনুপস্থিতির অভিযোগ আসলে একটা আয়না,
যেখানে আমরা নিজেদের সামাজিক ব্যর্থতা দেখতে পাই।
যেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থা, নীরব প্রশাসন এবং ভয়ভীত নাগরিক সমাজ–
মিলে ঈশ্বরের অভাবকে বাড়িয়ে দেয়।
অর্থাৎ, ঈশ্বর নীরব নন– আমরা বধির।
ঈশ্বরঃ ধারণা নাকি অভিজ্ঞতা?
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্ন আসলে যুক্তি দিয়ে নয়, অনুভব দিয়েই শুরু হয়।
যে মুহূর্তে মানুষ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে কারও কাছে প্রার্থনা করে,
সেই মুহুর্তেই ঈশ্বরের ধারণা বাস্তব হয়ে ওঠে–
সে ঈশ্বর সত্যিই আছেন কি নেই, তা গাণিতিক সমীকরণে মাপা যায় না।
ঈশ্বর তখন এক মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয়, এক নৈতিক ভিত্তি,
যা মানুষকে অন্যায়ের মাঝেও টিকে থাকার সাহস দেয়।
তাই কেউ যখন বলে ঈশ্বর নেই, তখন সে আসলে বলছে–
“আমি আর কোনও নৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি ভরসা রাখতে পারছি না।”
এই স্বীকারোক্তি এক গভীর হতাশার প্রকাশও বটে।
যুক্তির সীমা ও মানবিক আকাঙ্ক্ষা
যতই দর্শন ব্যাখ্যা করুক,
ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
কারণ মানুষের যুক্তি, সময় ও ইন্দ্রিয়ের সীমার মধ্যে কাজ করে,
কিন্তু ঈশ্বর– যদি থাকেন– তিনি সময় ও ইন্দ্রিয়ের বাইরে।
তবুও মানুষ প্রশ্ন করে, কারণ মানুষ প্রশ্নহীন থাকতে পারে না।
অন্যায়ের মধ্যে থেকেও সে খুঁজে ফেরে ন্যায়ের কোনও ছায়া,
যেমন অন্ধকারেও চোখ আলো খোঁজে।
এই অনুসন্ধানই মানুষকে শুধু জিজ্ঞাসু নয়, নৈতিকও করে তোলে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ, দয়ার প্রকাশ, ভালোবাসা–
এই সবকিছুর মধ্যেই হয়তো ঈশ্বরের ক্ষীণ উপস্থিতি জেগে ওঠে।
ঈশ্বরের নীরবতাঃ এক মানবিক প্রতিফলন
আমরা যখন বলি– “ঈশ্বর নীরব”, তখন হয়তো আসলে বলছি,
আমাদের নৈতিক সাড়া কমে গেছে।
যখন সমাজ অন্যায়ের প্রতি অসংবেদনশীল হয়,
যখন সত্য বলার মানুষরা একে একে হারিয়ে যায়,
তখন ঈশ্বর নীরব নন– বরং আমাদের বিবেক ঘুমিয়ে পড়ে।
ঈশ্বরকে না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে প্রশ্ন করি,
কিন্তু কখনও নিজেদের প্রশ্ন করি না–
আমরা কি নিজেরাই ঈশ্বরের পাঠানো ন্যায়বোধের দায়িত্বটা পালন করছি?
যে ঈশ্বরের ন্যায়ের খোঁজ আমরা বাইরে করি,
সেই ন্যায়ের বীজটা হয়তো তিনি রোপণ করেছেন আমাদের ভিতরেই।
কিন্তু সেই বীজের মাটি কখনও শুকিয়ে যায়
তবে জীবনের কষ্টই এর মাটি ও জল–
যার ভিতর দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে পরিণত, সহনশীল ও আলোকিত।
কিন্তু সে যাই হোক,
এভাবেই কিন্তু ধীরে ধীরে সেইসব মানুষ অমানবিক হয়ে উঠছে।
কষ্ট সব সময় মানুষকে আলোকিত করে না।
অতিরিক্ত দুঃখ আর অবিচার মানুষের ভিতরের কোমলতা শুকিয়ে দেয়।
সে হয়তো অন্যায় করে না, কিন্তু ন্যায়ের প্রতিও বিশ্বাস রাখে না আর।
এই নির্লিপ্ততাই অমানবিকতার সূচনা।
ঈশ্বর হয়তো ন্যায়ের প্রতীক
কিন্তু ন্যায় প্রতিষ্ঠা মানুষেরই কর্তব্য
ঈশ্বর আছেন কি নেই–
এ প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর হয়তো কোনও দিনও পাওয়া যাবে না।
তবে একথা নিশ্চিত,
ন্যায়ের অস্তিত্ব কেবল ঈশ্বরের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে না।
তা বরং দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের বিবেক, সাহস আর দায়িত্ববোধের উপর।
যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে তিনি মানুষের ভিতর স্থাপন করেছেন সেই ন্যায়ের বীজ;
আর যদি না-ও থাকেন, তবুও ন্যায়ের পথে হাঁটা আমাদের মানবিক কর্তব্য।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সহানুভূতি ও সত্যের প্রতি স্থিরতা–
এই তিন-ই আসল প্রার্থনা, আসল বিশ্বাস।
অতএব ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন– যে মানুষ অন্যায়ের সামনে নীরব থাকে,
সে-ই প্রকৃত নীরব ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
আর যে ন্যায়ের জন্য লড়ে, সে-ই প্রমাণ করে ঈশ্বর শুধু ধারণা নন,
তিনি মানুষের বিবেকের মধ্যেই জেগে আছেন।
( কিন্তু আরও গভীরে দরজা থাকে একবারেই শক্তভাবে বন্ধ,
যেন কোনো “টুঁ” শব্দটাও পাওয়া কঠিন।
পড়ুন– Click: Dark Web: Internet-এর অন্ধকার জগৎ, রহস্য! )
Articlesবাংলা Bangla Articles, Quotes & Prose-Poetry / বাংলা প্রবন্ধ, উক্তি ও গদ্য-কবিতা।




