সবুজের ঠিক নিচেই ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন বিপদ-
দরজাটা খুলে উঁকি দেবে কে?
অজানার হাতছানি আর অরণ্যের টানে, রহস্য রাজ্যে এ এক রোমাঞ্চকর অভিযান।
ইতিমধ্যে প্ল্যান করে ফেলেছেন নাকি?
বা ভবিষ্যতে কখনও করবেন ভেবেছেন রুদ্ধশ্বাস সে সব রহস্যের খোঁজে,
এক নিমেষেই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার?
জীবন যেখানে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যায়, ঠিক সেখানেই শুরু হয় অ্যাডভেঞ্চার,
আর বিশেষত অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু মানুষদের জন্যে আজকের এই ছোট্ট আর্টিকেলঃ
অ্যামাজন রেইনফরেস্ট- অজানা রাজ্যের প্রবেশদ্বারঃ
যদি পৃথিবীতে এমন কোনও জায়গা থেকে থাকে,
যা একবিংশের মাঝখানে পৌঁছে আজও মানব সভ্যতার কাছে রয়ে গেছে এক অনাবিষ্কৃত ধাঁধা হয়ে,
যেখানে আলো এখনও পায়নি প্রবেশের অনুমতি।
নির্জনতার শিকড়ে, আনুমানিক ৫ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৬ কোটি বছর ধরে
প্রকৃতি যেখানে নিঃশব্দে খুলে রেখেছে এক গোপন পাঠশালা, তা হল “অ্যামাজন রেইন-ফরেস্ট!!”
এই বিশালদেহী, ঘন, সবুজ জঙ্গলের প্রতিটা কোষে লুকিয়ে আছে রহস্যের বীজ।
এ জঙ্গল, এর মাত্রা ছাড়িয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার ন’টা দেশ পর্যন্ত,
যার ৬০% পড়েছে ব্রাজিলে।
একে কেবল একটা বন বললে ভুলটা হবে আমাদেরই।
এ এক রহস্য-রোমাঞ্চের আঁতুড়ঘর!!
কিভাবে যাবেন?
ভারতের যে কোনও বড় শহর-
দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই বা কোলকাতা থেকে প্রথমে আকাশে উড়ে পোঁছে যেতে হবে,
ব্রাজিলের ‘সাও পাওলো’ বা ‘রিও ডি জেনেইরো’তে।
সেখান থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে-‘মানাউস’ শহরে, যেটা পরিচিত “অ্যামাজনের প্রবেশদ্বার” হিসেবে।
মানাউস পৌঁছে পাওয়া যাবে স্থানীয় ট্যুর অপারেটর,
যারা ব্যবস্থা করে দেয় অ্যামাজনের নির্দিষ্ট অংশে ভ্রমণের ব্যবস্থা।
( সমগ্র মানবজাতি সমেত আমাদের এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন,
কিন্তু অসীম মহাবিশ্বের অন্ধকারে তখনও ভেসে বেড়াবে ভয়েজার,
চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে আমাদের থেকে!!
পড়ুনঃ সীমাহীন মহাশূন্যের রহস্যময় অন্ধকারে একা যাত্রীঃ ভয়েজার! )
কত ভিতর পর্যন্ত যেতে পারবেন?
বেশিরভাগ ট্যুর অপারেটর বা অর্গানাইজেশন’ই আপনাকে নিয়ে যাবে মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত,
যেখানে রয়েছে নদীপথ, কাঠের কটেজ , হাইকিং ট্রেইল আর অবশ্যই গাইডসহ গভীর জঙ্গল ভ্রমণ।
তবে সরকারি অনুমতি ছাড়া, অত্যন্ত গভীর ও সংরক্ষিত এলাকাগুলোয় যাওয়া নিষিদ্ধ,
কারণ সেই স্থানগুলো সেখানকার আদিবাসী, উপজাতি বা দুর্ধর্ষ বন্যপ্রাণে পূর্ণ।
সেখানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আজও বেশ কঠিন, পাশাপাশি এদের সভ্যতা, সংস্কৃতি
ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, রেস্ট্রিকশন বাধ্যতামূলক হিসেবে এখনও বিবেচিত।
দেখার মতন কি কি পাবেন?
বন্যপ্রাণী (Wildlife)-এর মেলাঃ
অ্যামাজন মানেই জীবনব্যাপী এক গভীর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা।
এখানে আপনি দেখতে পাবেন-
দিনে বা রাতে ট্যুরে গেলে সাধারণত যে প্রাণীদের আপনি দেখতে পাবেন-
- ক্যাপুচিন বানর।
- হাউলার বানর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে গাছের ডালে-ডালে।
- ভাগ্য সঙ্গ দিলে দেখবেন ছোটো বা মাঝারি আকারের অ্যানাকোন্ডা।
- উজ্জ্বল রঙের ছোটো, কিন্তু বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগ।
- তৌকান বা ম্যাকাও পাখি।
- নদী বা কোনও জলাভূমির ধারে দেখতে পাবেন কাইমান কুমির।
- এছাড়া গুহা কিংবা বড় গাছের শরীরে বাদুড়ের দল।
বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ তথা অরণ্যজগৎঃ
এখানে পৌঁছে আপনি দেখতে পাবেন-
- কাপোক ট্রি (Ceiba Tree), যার রূপ অনেকটা বিশাল বটগাছের মতন।
- এছাড়া অন্যান্য কিছু গাছ লম্বায় ২০০ ফুট বা এর বেশিও অনায়াসেই হয়।
- পাবেন পাম, মেহগনি, রাবার, বিভিন্ন প্রজাতির শ্যাওলা, ওষধি গাছ, লতা ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, প্রত্যেকটা গাছেরই কিন্তু আবার গল্প আছে।
কেউ ব্যবহৃত হয় চিকিৎসায়, তো কেউ আবার বিষে।
নদী ও জলজ অভিজ্ঞতাঃ
- জঙ্গলের দেহ চিরে সাপের মতন এঁকেবেঁকে বয়ে চলা, জলপ্রবাহে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যামাজন নদী,
যা গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ২ লক্ষ + কিউবিক মিটার জল দিয়ে থাকে সাগরকে।
এই নদী একাই পৃথিবীর মিষ্টি জলের ২০% সরবরাহ করে। - সেখানে পাবেন পিঙ্ক রিভার ডলফিন, যার দেখা মেলে ইকিটোস বা মানাউসের আশপাশে।
- এছাড়া মাছ ধরার অভিজ্ঞতায় জল থেকে উঠে আসে সেই মানুষ খুনি মাছ পিরনহা‘র প্রসঙ্গও।
গভীর বনের ভিতরে সরু জলে নৌকা ভ্রমণ চান?
- আছে ক্যানো ট্রিপ।
আদিবাসী গ্রাম ও জীবনধারাঃ
- স্থানীয় উপজাতিদের গ্রামে গিয়ে তাঁদের সংস্কৃতি, ভাষা, অস্ত্র প্রভৃতি দেখা, গান শোনা।
- কিছু ট্যুরে সুযোগ থাকে স্থানীয় রান্না ও হস্তশিল্প দেখারও।
রাতের জঙ্গল ট্রেকিংঃ
- হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছু, ব্যাঙ, মাকড়সা ও বিচিত্র সব পিঁপড়ে।
আর এ অভিজ্ঞতা খুবই রোমাঞ্চকর ও গহীন অন্ধকারে যেন চমকে দেয় কল্পনাকেও।
রহস্যে মোড়া প্রকৃতির নিস্তব্ধতাঃ
- বিভিন্ন পাখির নানান রকমের ডাক।
- গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ।
- হঠাৎ হঠাৎ প্রাণীর ছায়া।
- কখনও কখনও প্ল্যান্টস ও প্রাণীদের জৈবিক প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় নিজের চোখে।
সব মিলিয়ে এটাই অ্যামাজনের একান্ত গোপন রহস্য!
অ্যামাজনের নিষিদ্ধ নদীঃ
অনেক উপজাতি আছে যাঁরা বাইরের জগতের সঙ্গে আজও কোনো যোগাযোগ রাখে না,
রাখতে পছন্দ করে না বলাটাই এখানে যুক্তিসঙ্গত।
কিছু কিছু অভিযাত্রীরা দাবি করেন যে-
গভীর জঙ্গলে প্রাচীন পিরামিড সদৃশ গঠন ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন।
স্থানীয়দের মুখে UFO ও আকাশে কোনো কোনো সময়ে অদ্ভুৎ (Strange) আলো দেখার গল্পও আপনি শুনতে পারেন।
অ্যামাজনের গভীর বনে এক ‘নিষিদ্ধ নদী’ আছে, যার তাপমাত্রা এতটাই বেশি বলে প্রচলিত,
যার জল দিয়ে নাকি জীবন্ত প্রাণীকে অনায়াসে সিদ্ধ করা যায়।
এটা “Shanay–Timpishka” নামে পরিচিত।
এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে বটে, কিন্তু যারা সেখানে গেছেন,
ফিরে এসেছেন চোখে এক বুক ভয় আর মুখে স্তব্ধতা নিয়ে।
আবার কেউ কেউ তো বলেন, জঙ্গল গভীরের কোনো এক জায়গায় আজও রয়েছে এমন এক পাথরের শহর,
যেখানে পাথর নিজে নাকি নড়েচড়ে, আর সেখানে হারিয়ে যায় সময়-জ্ঞান।
যাত্রা শুরুর আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শঃ
- Yellow Fever ও অন্যান্য ভ্যাক্সিন সাথে নিয়ে নেবেন।
- স্থানীয় ট্যুর কোম্পানি ছাড়া নিজেরা প্রবেশ করতে যাবেন না।
- জলরোধী পোশাক, ইনসেক্ট রেপেলেন্ট, মেডিকেল কিট সাথে অবশ্যই রাখবেন।
- ইংরিজি না জানলে সঙ্গে নিয়ে নেবেন অনুবাদক বা ট্রান্সলেটর
হিসেবে কোনও অ্যাপ বা মানুষ, কারণ বেশিরভাগ মানুষ সেখানে কথা বলেন পর্তুগিজ ভাষায়।
আর যদি জেনে থাকেন এ ভাষা, তো কোনও কথা নেই।
অ্যামাজন রেইন ফরেস্ট- Curupira ঃ
পৃথিবীর হার্টবিটের নিচে লুকিয়ে থাকা এক অজানা ব্রহ্মাণ্ড।
সবুজে মোড়া, কিন্তু নিস্তব্ধ নয়, শব্দে পূর্ণ, তবুও নিঃসঙ্গ।
চোখের সামনে ছড়িয়ে হাজার মাইলের অন্ধকার, ঘন সবুজ যেন টেনে নিয়ে যেতে চায় এমন এক জায়গায়,
যেখানে সময় থেমে গেছে হাজার বছর আগেই।
জঙ্গলে ঢুকলেই অনুভব হবে-
আপনি কেবল একটা দৈত্যাকার বনভূমিতে নয়, বরং প্রবেশ করেছেন এক বিকল্প বাস্তবতায়,
যেখানে বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভেজা পাতার গন্ধ, বনের মিশ্র গন্ধ আর অদ্ভুৎ শব্দের সুর।
হঠাৎ মনে হবে-
কেউ যেন আপনাকে লুকিয়ে অনুসরণ করছে, কিন্তু পিছনে তাকালেই দেখা যাবে,
জমকালো বিভিন্ন আকৃতির ছায়া!
আর সে সময়ে স্বভাবতই হৃদপিণ্ড কথা বলবেও অনেক বেশি।
রাত্রি এখানে নিঃসঙ্গ নয় বরং সবচেয়ে বেশি জীবন্ত, পাতার ফাঁকে জ্বলজ্বলে দুই চোখ।
গাছের দেহে আচমকাই নড়াচড়া, দূরে অচেনা বাঁশির মতন শব্দ এসে আছাড় খাবে আপনার কানের পর্দায়।
আর এই সুরের আড়ালেই স্থানীয়রা বলে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় সত্তা- ‘Curupira ,’
অরণ্যের অভিশপ্ত রক্ষক, যার পা বাঁকানো পিছনের দিকে।
সে আপনাকে ডাকবে, চেষ্টা করবে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার-আপনি যদি সাড়া দেন,
তবে হারিয়ে যাবেন চিরতরে।
লোককথা অনুযায়ী এই Curupira প্রকৃতির ক্ষেত্রে অরণ্যের রক্ষক
এবং যারা নির্দ্বিধায় গাছ কাটে, বন ধ্বংস করে, বন্য প্রাণী হত্যা করে,
তাদের জন্যে অরণ্যের অভিশপ্ত রক্ষক।
যাক সেখানে তবু এখনও প্রোমোটার, শিল্পপতি বা রাজনীতিবিদ নেই,
এখানেই সেই অরণ্যের বাবার সৌভাগ্য।
অ্যামাজনের অমীমাংসিত রহস্যঃ
বিষ্ময়ে হতবাক করা এ জঙ্গলে এমন জায়গাও আছে-
যেখানে ব্যর্থ হয় GPS, কম্পাস ঘুরে হয় পাগল, আর ঘড়ি থেমে যায় হঠাৎ।
স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে এক রহস্যময় গঠন,
যা প্রাচীন কোনও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ হতে পারে-
কিন্তু যতবার কেউ ওদিকে যেতে চেয়েছে, ফিরে এসেছে হয় অসুস্থ হয়ে,
নচেৎ আর ফেরেনি কোনও দিন।
অ্যামাজনের প্রকৃতি যেন একাধারে দেবী ও দানব।
সৌন্দর্যের সাম্রাজ্য দিয়ে যেমন মুগ্ধ করে, তেমনই আবার রহস্য দিয়ে যেন গ্রাস করতে চায় আপনাকে।
এখানে আসা মানে শুধুমাত্র একটা ভ্রমণ বা জায়গা দেখা নয়,
বরং নিজের ভয়, কৌতুহল, আগ্রহ ও চেতনার এক ঘুটঘুটে অন্ধকারের অতল গভীরে ডুব দেওয়া।
কারণ অ্যামাজন শুধু জঙ্গল নয়- হেটে-ছুটে বেড়ানো এ এক জীবন্ত রহস্য,
এক অন্ধকার জাদুবাস্তবতা, যেখানে আপনি ভুলে যেতেই পারেন নিজের পরিচয়।
সবশেষেঃ
সারাজীবনে একবার যদি যাওয়া যায় পৃথিবীর ফুসফুস, অর্থাৎ অ্যামাজনে,
বোধকরি আ-মৃত্যু তা হয়ে থাকবে, জীবনের শ্রেষ্ঠ, রহস্যে-রোমাঞ্চে,
ভয়-ভীতিতে ভরপুর এক অমর অভিজ্ঞতা।
তন্ময় সিংহ রায়