গলির নারী
শহরের এক গলিতে,
যেখানে আলোরও লজ্জা লাগে ঢুকতে,
বসে থাকে কিছু নারী–
যেন ইতিহাসের মুখে পাউডার ঢাকা এক দাগ।
যেন ভদ্রলোকের পৃথিবীর গোপন বৈধতা।
এদের মুখে লিপস্টিক নয়,
সময়ের কালি লেগে আছে।
চোখে আলো নেই, আছে ক্লান্ত অপেক্ষা,
আছে বেঁচে থাকার অভিশাপ!
সমাজের বিচিত্র সমীকরণ
মানুষ তাঁদের ঘৃণা করে,
তবু প্রয়োজন ফুরোয় না,
কারণ সভ্যতার মূলে একটা অদ্ভুত সমীকরণ আছে।
কিছু নারীকে “অপবিত্র” ঘোষিত না করলে,
বাকি নারীসমাজ “পবিত্র” হতে পারে না।

রাত গভীর হলে, এ শহর ঘুমোয় না,
বরং খুলে ফেলে তার নীতির পোশাক।
সেই ফাঁকে এরা মুখ দেখে আয়নায়,
এ ভাবেই মনে করে–
এখনও বেঁচে আছে।
সময়ের দাসী
ওরা বসে থাকে জানালার ধারে,
যেন সময়ের দাসী,
যাদের চোখে নক্ষত্র নয়–
আছে পুড়ে যাওয়া মানবতার ছাই।
ওদের হাসি কোনও আনন্দ নয়,
ওটা এক প্রাচীন প্রতিরোধ,
যাতে পৃথিবী এখনও নিজেকে “ভদ্রলোক” বলতে পারে।
নীরব লেনদেন
প্রতিদিন কিছু পুরুষ আসে,
শরীর কিনে নেয়, মন রেখে যায় ধুলোয় মিশিয়ে।
ওরা জানে, এই লেনদেনে ভালোবাসা আসে না,
আসে একরকম নীরব রুটি,
যাতে বেঁচে থাকা যায় পরের দিনটুকু।
কেউ ডাকে “পতিতা,” কেউ “বেশ্যা।”
কারো চোখে “দোষিণী,” “পাপিণী।”
কিন্তু কেউ ভাবে না–
ওদেরও তো কোনোদিন নাম ছিল, ডাকনাম ছিল,
কোনো মা একদিন কোলে তুলে বলেছিল–
“এটা আমায় মেয়ে!”

( দুজন যেন দুই নেকড়ে,
একই থালায় রক্ত খায়।
একদিন এই ছাই থেকে নতুন প্রজন্ম জেগে উঠবে,
যারা বলবে….
পড়ুন– Click: দুই নেকড়ে! )
ধৈর্য্য ও প্রার্থনা
আজ সেই নামগুলো হারিয়ে গেছে মদের গন্ধে,
আলো-ছায়ার ভাঁজে, বালিশে, চাদরে।
কিন্তু ওরা ধৈর্য্য হারায়নি।
কারণ ওরা জানে–
যন্ত্রণা যদি প্রতিদিনের রুটি হয়,
তাহলে সহ্য করাই একমাত্র প্রার্থনা।
যে ধর্ম প্রেমের কথা বলে,
সে-ই এদের দরজায় নেমে আসে ছদ্মবেশে।
যে পুরুষ ঘরে ঈশ্বরের সামনে মাথা নোয়ায়,
রাত বাড়লে সে-ই ছুটে আসে এখানে,
নিজের নোংরা সত্যটা ঝেড়ে দিতে।
অমূল্য যন্ত্রণার দাম
ওরা জানে–
কেউ ওদের জন্যে প্রার্থনা করে না।
ওদের দেহের দাম দিলেও, যন্ত্রণাকে কেউ মূল্য দেয় না।
কোনও চিঠি স্বর্গ থেকে ওদের জন্যে আসবে না।
ওরা জানে–
লাঞ্ছনা, অপমান প্রতিদিন কিভাবে গিলে নিতে হয়।
চোখে জল আসতে নেই,
কারণ কান্নার বিলাসিতা ওদের জন্যে নয়।
প্রতিদিন কিছু পুরুষ আসে,
ব্যবহার করে, আর চলে যায়।
যেন ওরা মানুষ নয়,
একটা প্রয়োজনের আঁতুড়ঘর,
যার দরজায় লেখা– “পাপ,”
কিন্তু ভিতরে জ্বলছে–
হাজার বছরের ত্যাগের আগুন।
লালসা ও সমাজের ফুল
প্রতিদিন এদের শরীরে জমে লালসার আবর্জনা,
যাতে সংসারের ফুলটা সকালবেলায় নির্মল দেখায়।
এরা না থাকলে–
সমাজের সব শুদ্ধতা পচে যেত নিজের কামনায়।
নীতির কপাল থেকে ঝরে পড়ত সব পবিত্রতার রঙ।
কারণ সভ্যতা বেঁচে আছে ঠিক সেই গলির ভিতর,
যেখানে প্রতিরাতে “পাপ” নিজের দায়িত্ব পালন করে।

আগুনে বেঁচে থাকা
যেদিন এরা সব একসাথে হারিয়ে যাবে,
সেদিন সভ্যতা মুখ হারাবে।
ধর্ম তখন বুঝবে,
যে মেয়েদের লজ্জায় ঢেকে রেখেছিল,
তাঁদেরই যন্ত্রণায় টিকে ছিল তার নৈতিকতা।
এরা আগুনে বাস করে,
তবুও ছাই হয় না।
কারণ– এদের ভিতরে এমন এক নিঃশব্দ শক্তি আছে,
যা হয়তো ঈশ্বরেরও বোঝার বাইরে।
এরা সেই প্রাচীন শিখা,
যার আলোয় মানুষ আজও নিজের অন্ধকার দেখতে পায়।
কলঙ্কিত অধ্যায়
ইতিহাস হয়তো এদের রাখবে আলাদা পাতায়,
শিরোনাম পাবে– “কলঙ্কিত অধ্যায়।”
কিন্তু ঈশ্বর জানবেন–
যারা প্রতিদিন যন্ত্রণায় ছাই হয়েও আলো জ্বালাতো,
তাঁরাই প্রকৃত সাধ্বী।
( কতজন কত কিছু দিতে চায়।
দিতে চায় ভালোবাসা, সম্মান, ভক্তি।
যেন ঈশ্বরের দূত নেমে এসেছে ধরার বুকে।
পড়ুন– Click: সেন বাড়ির ছেলেটা আজ “মানুষ” হয়েছে ! )
Articlesবাংলা Bangla Articles, Quotes & Prose-Poetry / বাংলা প্রবন্ধ, উক্তি ও গদ্য-কবিতা।