অ্যালগরিদম যখন ইতিহাস লেখক, মানুষ তখন শুধুই চরিত্র!

শ্রেষ্ঠ অর্জন, নাকি বুদ্ধিমত্তার নিষ্ক্রিয়তা?

বুদ্ধিমত্তা মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন,
অথচ আজ সেই বুদ্ধিমত্তাই কৃত্রিমের হাতে হয়ে উঠেছে ছায়াবৎ।
AI এখন আর নিছক প্রোগ্রামের পরিণতি নয়, বরং এ এক স্বয়ংক্রিয়, অদৃশ্য শক্তি, যা এগিয়ে চলেছে নির্বিচারেচ, দুর্বার গতিকে সাথে নিয়ে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অগ্রগতি থমকে দাঁড়াবে কোথায় গিয়ে?
আদৌ কি থামবে?
বিগত এক দশকে এর অপ্রতিরোধ্য বিকাশ যেমন বিষ্ময়কর, তেমনই উদ্বেগজনক!

AI বিকাশ- বিস্ময়কর না উদ্বেগজনক?

চ্যাট জি পি টি থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ ড্রোন, আবার ডিপফেক ভিডিও থেকে নিয়ন্ত্রিত জনমত, প্রযুক্তি এখন থাবা বসাচ্ছে মানুষের সিদ্ধান্তের উপরে।

নিয়ন্ত্রণহীন প্রযুক্তি ও নীতির অভাবঃ

এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মতন নেই কোনও সার্বজনীন নীতিমালা, নেই কোনও দার্শনিক গাইডলাইন তথা আন্তর্জাতিক কোনও সমঝোতা।
যেন ট্রাফিক নিয়মের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে ব্রেকহীনভাবে অবিরত ছুটে চলেছে এই প্রযুক্তি খোলা রাস্তায়।
যেন সভ্যতা এক বিশাল পরীক্ষাগার, আর আমরাই হচ্ছি সেই পরীক্ষার বিষয়বস্তু।

( যে ভারত একদা ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা,
যে ভারতের গুরুকুলে একজন ছাত্রকে জ্ঞান অর্জন করতে হত
এক যুগ (১২ বছর) কাটিয়ে-
সেই ভারতের ছাত্রকে আজ স্মার্ট ফোন খুলে খুঁজতে হয়-
‘Top 10 Life Changing Hacks To Become Instantly Smart Or Intelligent.’
পড়তে পারেন লেখাটা নিচে ক্লিক করেঃ )

“নালন্দার ছায়ায় দাঁড়িয়ে, Google এর Data Cloud- এ ঝুলন্ত ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষ!”

কর্মসংস্থান থেকে ভবিষ্যতের অস্তিত্ব সংকটঃ

শুধুমাত্র কর্মসংস্থানে বিঘ্ন ঘটাবে না, এ প্রযুক্তি প্রকাশ্যে রাজপথে দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে অস্তিত্বের।
‘মেশিন লার্নিং’ যখন শেখে আত্মনিয়ন্ত্রণ, তখন এর আচরণও হয় অপ্রত্যাশিত।
কোনও অ্যালগরিদম যদি নেয় ভুল সিদ্ধান্ত, কে নেবে এর দায়?
কে ঠিক করবে ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা?
আইন, নীতি ও নৈতিকতা- সবই নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে এই যান্ত্রিক যাত্রার কাছে।

AI Pause ও বৈশ্বিক সতর্কবার্তাঃ

বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই ডাক দিয়েছেন ‘AI Pause’ বা নিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের, কিন্তু কর্পোরেট লালসা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতা সেই সতর্ক বার্তাকে আজ ব্যঙ্গ করে চলেছে, যার পরিণাম কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, সর্বোপরি অস্তিত্বের!
ভবিষ্যতের ভয় এখানেই, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার হয়তো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে অবলুপ্তির পথে, এবং শোষিত হবে এই প্রযুক্তির দ্বারাই, যা একদা যত্ন করে হাতে গড়েছে মানুষ নিজেই।

ভবিষ্যৎ সভ্যতা-মানুষ নাকি যন্ত্রের শাসন?

তাই আজ প্রশ্ন শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের নয়, বরং এক দিকনির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ।
প্রশ্ন জন্ম নেয় এখানেও যে, ভবিষ্যৎ সভ্যতা তবে কি গড়ে উঠবে মানুষ-কেন্দ্রিক নীতি নির্ভর হয়ে, না কি এক নৈর্ব্যক্তিক যন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থার বলিষ্ঠ দু-বাহুতে চলে যাবে সমগ্র পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ?
বহু কিছুর উত্তর কেউ না দিক, দিয়ে দেয় সময়, তেমনই এ উত্তরটাও দেবে সময়, সে তো বোঝা গেল, কিন্তু বর্তমানে প্ল্যাকার্ডের মতন প্রশ্ন উঁচিয়ে ধরার দায়টা কিন্তু আমাদেরই।

যন্ত্রের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়াঃ

আমরা এক অদ্ভুত যুগে প্রবেশ করেছি- যেখানে যন্ত্র চিন্তা করে, মানুষ বিশ্বাস করে, আর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ সরে যাচ্ছে সেই হাত থেকে, যার রক্তে আছে উত্তেজনা।

হাতিয়ার নয়, হয়ে উঠেছে সিস্টেমঃ

‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ এখন আর কোন হাতিয়ার নয়, এসে সামনে দাঁড়িয়েছে এক সিস্টেম রূপে।
এই সিস্টেম এমন এক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সভ্যতাকে, যেখানে মানুষ তাঁর চেতনাসম্পন্ন দুর্বলতা দিয়েই বিবেচিত হতে চলেছে অযোগ্য বলে।
কোনও আবেগ জানেনা AI, এর নেই কোনও দ্বিধা, অনুশোচনা, আর এসবেই লুকিয়ে বসে আছে ভবিষ্যতের সমূহ বিপদ সংকেত!

মানবিকতার স্থান কোথায়?

চেতনার উপস্থিতিতে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে মানবিকতার বাসস্থান কোথায়?
ভবিষ্যতের আদালত তখন বিচার করবে কি কোডের ভাষায়?
যুদ্ধ কি চালাবে স্বনির্ভর ‘স্বাক্ষরহীন’ ড্রোন?
আর সাংবাদিকতা?
তা কি হয়ে উঠবে নিছক এক ডেটা-সংশ্লিষ্ট ভাষা বিশ্লেষণের খেলা?

মানুষ কি নিজের স্থানচ্যুতি তৈরি করছে?

সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, মানুষ নিজেই আত্মহারা হয়ে, বিপুল উত্তেজনা, আগ্রহ, কৌতুহল আর পরিশ্রমে তৈরি করেছে তাঁদের বিকল্প,
কিন্তু আদৌ কোনও সংস্কৃতি কি টিকতে পারে,
যেখানে সৃষ্টিকর্তা নিজেই রচনা করে নিজের স্থানচ্যুতি?
যন্ত্র যখন শিখে যায় অনুভূতির অনুকরণ, তখন বেমালুম মুছে যায় সত্য আর অভিনয়ের ফারাকটাও।
সেখানে মানুষ আর থাকে না মানুষ, ওঠে এক ‘ডিজিটাল লাইসেন্সধারী এক্সিসটেন্স’ হয়ে।

মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎঃ

সবশেষে মন ভেদ করে উঠে এল এই প্রশ্ন— আগামীর দিনগুলোতে হয়তো আইন থাকবে, থাকবে রাষ্ট্র, জল, বাতাস, মাটি, খবর, কিন্তু মানুষ থাকবে তো?
না কি থাকবে এক ইতিহাস, যা লেখা হবে যন্ত্রের ভাষায়?

যন্ত্র জানবে ডেটা, বুঝবে না আবেগ!

যন্ত্রের ভাষা, যা হয়তো পারবে প্রতিটা শব্দ বিশ্লেষণ করতে, কিন্তু বুঝতে পারবে না চোখের জল আর মনের অনুরণন।
যেখানে ‘দুঃখ’ হবে শুধু একটা ইনপুট ট্যাগ, ‘ভালোবাসা’ এক সিগন্যাল প্রসেসিং, অথচ এর অন্তর্নিহিত অর্থ হারিয়ে যাবে ছায়ার মতন।
একটা সময় এসে আমরা হয়তো ভুলে যাব কিভাবে অনুভব করতে হয়, কারণ অনুভবের কাজটাও তখন করে দেবে কোনো অ্যালগরিদম।
আমাদের গল্পগুলো তখন লেখা হবে নিখুঁত গাণিতিক যুক্তিতে, অথচ তাতে থাকবে না কোনও ভুলের আবেশ, যা একেকটা মনুষ্য অভিজ্ঞতাকে করে তোলে অসাধারণ।

অসম্পূর্ণতার অপচয়ঃ

মানুষের যে ‘অসম্পূর্ণতা’ তাঁকে করে তোলে পূর্ণতার দিকে ধাবিত,
সেই অসম্পূর্ণতাই একদিন হয়ে উঠবে ‘ডিজিটাল অপচয়।’
আমরা হয়তো স্মৃতি সংরক্ষণ করবো ক্লাউডে,
কিন্তু হারাবো সেই মুহূর্তটাকে,
যা এক কাপ চায়ের ধোঁয়ার মতো এলোমেলো, অথচ অমূল্য।

ভাষা ও আবেগের হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যঃ

যন্ত্রের এই সমরূপতায় হারিয়ে যেতে পারে ভাষার আঞ্চলিকতা, গল্পের আবেগ, কবিতার দ্ব্যর্থকতা,
এমনকি চুপ করে থেকে কিছু না বলারও এক নিগূঢ় সৌন্দর্য।
প্রতিটা সিদ্ধান্ত হয়ে উঠবে র‍্যাশনালশ, অথচ তাতে থাকবে না কোনো মায়া , কোনো দ্বিধা, কোনো ‘না বুঝেও মেনে নেওয়ার’ সেই অনির্বচনীয়তা।

সার্চ ইঞ্জিন যুগ বনাম মানবিক সন্ধ্যাঃ

যখন সব প্রশ্নের উত্তর দেবে সার্চ ইঞ্জিন , তখন কি থাকবে সেই উত্তরহীন সন্ধ্যেগুলো , যেখানে মানুষ কেবল চেয়ে থাকত আকাশের দিকে?
যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও এর পিছনে থাকতো প্রেম , থাকত লজ্জা , থাকত এক অসহায় ‘মানবিকতা’, যাকে হয়তো কোনোদিনই লেখা যাবে না কোড দিয়ে।

ক্ষমা ও অনুশোচনার অনুপস্থিতিঃ

AI কখনও একান্তভাবে ভুলে যেতে পারবে না, আবার পারবে না অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ক্ষমাও চাইতে, অথচ এই দুইয়ের মাঝেই গড়ে তোলে সভ্যতা।
এতদিন যন্ত্র ছিল মানুষের তৈরি, আজ মানুষ হয়ে উঠেছে যন্ত্রের পুনঃসৃষ্টি- এক ‘ডিজিটাল রি-ইনভেনশন।’

ভবিষ্যতের ইতিহাস- যন্ত্রের হাতে লেখাঃ

ভবিষ্যতের পৃথিবীতে থাকবে হয়তো সবকিছু , থাকবে না শুধু সেই ‘ভুল করে ফেলার অধিকার’,
যা মানুষকে করে তোলে মানুষ।

আতঙ্ক এখানেও যে, একদিন শিশুরা যখন ইতিহাস পড়বে,
তাঁরা হয়তো দেখবে না কোন কবি, লেখক বা দার্শনিকের নাম।
দেখবে শুধু প্রটোকল, সফটওয়্যার, ভার্সন আর অ্যালগরিদমের ফাইনাল আপডেট।

লেখক তখন থাকবে শুধুই ‘চরিত্র’ হয়ে- আর ইতিহাস রচিত হবে যন্ত্রের হাতে!!

তন্ময় সিংহ রায়

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলঃ মায়ামি, হ্যামিলটন, সান হুয়ানের ত্রিভুজ। গভীর সমুদ্রে রহস্যময় স্টার গেট, জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল– সমুদ্রের অদৃশ্য রহস্য ত্রিভুজ!

রহস্যের সামনে নির্বাক সভ্যতাঃ পৃথিবী– এর গর্ভে আজও যে কত বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *