প্রাচীন ও মধ্য ভারত বনাম বর্তমান ভারত :
অতীতের আলো, বর্তমানের ছায়া!
মানুষ যখন খোঁজে তাঁর শিকড়,
তখন ফিরে যায় ইতিহাসের দরজায়।
আর ইতিহাস বললেই সেই শিকড় ছিঁড়ে উঠে আসে-
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার কথা।
১, ৪৭৫ বছর আগে ও ২৬৮ বছর আগে নিঁখোজ হয়েছিল-
কণাটুকুও পাওয়া গেল না আর!
এখন মনে হয় ভুল করেছিলাম
ভারতের ইতিহাস জেনে, পড়ে, বুঝে।
না পড়লে জানতাম না, না জানলে জন্মাতো না
কোনও অনুভূতি, জ্ঞান, আর না জন্মালে-
খারাপ লাগাগুলো আজ ব্যাকটেরিয়া হয়ে ঘিরে ধরতো না ফুসফুসকে।
(আজকের বিশ্বব্যাপী মহাকাশ গবেষণার যে প্রতিযোগীতা,
যে উন্নতি, এর পিছনে কখনও কি স্মরণ করা হয় প্রাচীন
জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই পিতাকে?
জানতে পারেন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে।)
“আর্যভট্টঃ পৃথিবীর ইতিহাসে এক মাইলস্টোন!”
প্রাচীন যুগ- এর উন্নত ক্ষেত্র :
১. নগর পরিকল্পনা
২. গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
৩. আয়ুর্বেদ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান
৪. দর্শন ও জ্ঞানতত্ত্ব
৫. সাহিত্য ও ভাষা
৬. বাণিজ্য ও কারুশিল্প
৭. শাসন ও প্রশাসন
৮. স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
৯. কৃষি ও সেচ
১০. ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি।
মধ্যযুগ- এর উন্নত ক্ষেত্র :
১. স্থাপত্য ও শিল্পকলা
২. সাহিত্য
৩. সংগীত
৪. ধর্মীয় ভাবনা ও আন্দোলন
৫. প্রশাসনিক দক্ষতা
৬. বাণিজ্য
৭. শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা
৮. ভাষার বিকাশ
৯. কারুশিল্প ও হস্তশিল্প
১০. নৌ-বাহিনী ও যুদ্ধকৌশল
ঔপনিবেশিক যুগের উন্নতি নয় থেকেই যাক
অন্ধকারের অতল গভীরে।
নালন্দা ও তক্ষশীলার আলোকবর্তিকাঃ
দর্শন, জ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত ও মানবতাবাদ-এর নিরিখে
প্রাচীন ভারত ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটা।
“নালন্দা-তক্ষশীলা ছিল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।”
এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতি ছিল সময়ের সীমা পেরিয়ে যাওয়া এক আত্মালোকে দীপ্ত শিখা,
যেখানে অন্ধকারও ভুলে যেত নিজের অস্তিত্বকে।
শুধু কি তাই?
এই দুই মহা-বিদ্যাপীঠ ছিল এমন এক বোধিসত্ত্ব,
যার চিন্তাধারায় সভ্যতা কেবল শেখেনি,
শিখেছে নতুন করে জন্ম নিতে।
চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া-জাপান,
শ্রীলঙ্কা, পারস্য (বর্তমান ইরান), গান্ধার, বাখত্রিয়া (আজকের আফগানিস্তান)
থেকে বিদেশি জ্ঞানপিপাসুরা পর্যন্ত ছুটে আসত
এই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশ্যে।
গণিতের শূন্য, জ্যোতির্বিজ্ঞানের নাক্ষত্র বিদ্যা,
আয়ুর্বেদের জন্ম এখানেই।
মধ্যযুগে বিশ্ব জি ডি পি’র ২৫% এককভাবে ধারণ করত এই ভারত-
বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিতে ছিল অগ্রণী ভূমিকা।
প্রকৃতি ও প্রাচীন ভারতীয় মানসিকতাঃ
প্রাচীন ভারতের মানুষ সে সময় প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করত,
পূজা করত দেবতাজ্ঞানে।
সূর্য, নদী, বৃক্ষ, পশু সকলকেই দিত ঐশ্বরিক মর্যাদা।
ঋগ্বেদে উদিত সূর্য থেকে শুরু করে গঙ্গা-যমুনা,
অশ্বত্থ বৃক্ষ, গরু পর্যন্ত ছিল আরাধনার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ- বিশ্বাস :
প্রকৃতি মাতার সেবা মানেই ঈশ্বর সেবা, তাই ধ্বংস নয়, তাঁরা ধর্ম ভাবত সংরক্ষণকেই।
আর আধুনিক ভারতে??
ধ্বংসই হল একমাত্র ধর্ম।
আধুনিক ভারতের বিপরীত ছবিঃ
প্রযুক্তি ছুটছে দুর্বার গতিতে,
চতুর্দিকে নির্বিচারে গাছ খুন করে গড়ে উঠছে আধুনিক বাড়ি-ঘর,
বাংলো, ফ্ল্যাট-
শুধু হারিয়ে ফেলেছি শিকড়।
গাছ কাটলেই যেন মূল্য বাড়ে বাড়ির- মাটির কান্না আর কে শোনে?
বসুন্ধরার বুকে ইটের থাপ্পড় মেরে আমরা বলি “ডেভেলপমেন্ট।”
অথচ ভূমিকম্প হলে আবার ইঁদুর দৌড় দিই সেই গাছের ছায়ায়।
সবুজ হত্যা করে আমরা আকাশে মাথা ঠেকাই ছাদের-
পরে আমরাই আবার দোষ দিই বৃষ্টিকে।
( ভবিষ্যতে কি তবে মানুষের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে AI-এর হাতে?
যন্ত্র কি তবে ভবিষ্যতে লিখবে মানুষের ইতিহাস?
জানতে- পড়তে পারেন নিচের লেখাটা। )
“অ্যালগরিদম যখন ইতিহাস লেখক, মানুষ তখন শুধুই চরিত্র!”
শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়ঃ
নালন্দার জায়গায় মেরুদণ্ড দুমড়ে-মুষড়ে ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা,
চাণক্যের দর্শন-
আজ সব চাপা পড়ে গেছে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে।
ধর্ম, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি- সব যেন এখন ভাগাভাগির শিকার।
পেট ভরে, কিন্তু মনে একবুক শূন্যতা-
এই হল ‘উন্নয়ন’ এর আত্মপ্রতিকৃতি।
তথ্য আছে, কিন্তু জ্ঞান অনুপস্থিত,
স্বাধীনতা আছে, কিন্তু চিন্তা বন্দী খাঁচায়।
মন্দির-মসজিদ নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও-
অন্তর্জিজ্ঞাসার নীরব মৃত্যু ঘটে চলেছে প্রতিদিন।
রাজনীতির রুটিনের নিচে চাপা পড়ে গেছে সেই সংস্কৃতি,
যেখানে এককালে প্রশ্ন করাই ছিল পবিত্র কাজ।
হারানো সভ্যতার প্রশ্নঃ
আজকের প্রশ্ন তাই ব্যক্তিগত নয়, জাতিগত :
“সভ্যতা হারিয়ে আমরা কি আজ শুধুই হয়ে উঠেছি সিস্টেমের দাস?”
অতীতের ভারত কি শুধুই তবে থাকবে ইতিহাসের গুচ্ছখানেক পৃষ্ঠা হয়ে?
না কি এখনও আশা করা যায় একটা সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন?
জ্ঞান থেকে তথ্যের যাত্রাঃ
যে ভারত একদা ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা,
যে ভারতের গুরুকুলে একজন ছাত্রকে জ্ঞান অর্জন করতে হত
এক যুগ (১২ বছর) কাটিয়ে-
সেই ভারতের ছাত্রকে আজ স্মার্ট ফোন খুলে খুঁজতে হয়-
‘Top 10 Life Changing Hacks To Become Instantly Smart Or Intelligent!’
নালন্দার দেশ আজ ধুপ-ধুনোয় আরতি সম্পন্ন করে নোটস্-এর দয়ায় ভালো র্যাঙ্ককে,
আর উদ্ভাসিত হয় গর্বে।
জ্ঞান রপ্তানীর সেই ভূমি বিবর্তনের চাকায় পিষে আজ আমদানির কৃতদাস,
আর ‘Google হল গুরু।’
তক্ষশিলার উত্তরসূরিরা এখন PDF খুঁজে রাত বাঁচায় পরীক্ষার আগে।
যে মাটিতে ধুলো লাগত গুরুর পায়ে,
সে মাটির কোচিং সেন্টারের হোডিং-এ ঝোলে-
‘100% Success Guarantee!’
কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে ছাত্ররা আজ ভাবে,
সফলতা একটা Package, বুদ্ধি নয়।
বাণিজ্য ও অর্থনীতির পতনঃ
তাহলে মন ভেদ করে প্রশ্ন বেরিয়ে আসে,
“কোথায় হারিয়ে গেল সেই ভারত?”
যে ভারতকে আখ্যান করা হয়েছিল “সোনার পাখি” বলে?
একদা যে দেশের বাণিজ্য পথ ধরে রোমান সাম্রাজ্যের প্রাসাদে পৌঁছে যেত-
মশলা, রেশম,নীল আর হস্তশিল্প,
সেই ভারত আজ বিশ্ব অর্থনীতির চাকায় বসে আছে শুধু ভোক্তা হয়ে।
মুক্তমনা শিক্ষা বনাম প্রতিযোগিতাঃ
প্রাচীনকালের বৈদিক জ্ঞানচর্চা বা বৌদ্ধ দর্শনের মুক্তমনা শিক্ষা,
আজ রূপ নিয়েছে মার্ক্স-ধর্মী পরীক্ষার প্রতিযোগিতায়।
যেখানে নালন্দার ছাত্ররা ৯ টা আঙ্গিক (ব্যাকরণ, লজিক, চিকিৎসা,
দর্শন, শিল্পকলা, ধ্বনিতত্ত্ব, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা) নিয়ে
জীবন গড়ে তুলতো, সেখানে আজকের ছাত্ররা-
গুগুল-এর সার্চ বারে টাইপ করে, “Best Shortcut Notes For Last Night Study.”
এই বৈপরীত্য শুধু শিক্ষায় নয়, জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে।
কৃষি থেকে প্রযুক্তি, দর্শন থেকে চিকিৎসা,
সব জায়গায় পশ্চিমা ধারার প্রভাবকে আমরা গ্রহণ করেছি অন্ধ অনুকরণে।
অথচ “চড়ক সংহিতা” বা “সুশ্রুত সংহিতা”-র অমূল্য, অনন্য জ্ঞান
আজও দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র হয়েই।
শল্য চিকিৎসার পিতা সুশ্রুতের শিষ্যরা একসময় যে দেশকে
দুর্বার গতিতে নিয়ে যেত এগিয়ে,
সেই দেশেই আজ বিদেশি পেটেন্টের লাইসেন্স কিনে চালাতে হয় চিকিৎসা।
স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ক্যাটেগরিঃ
স্থাপত্যশিল্পেও সেই একই গল্প।
আজকের আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং,
যা বাহ্যিকতায় আধুনিক, কিন্তু স্থায়িত্বে কোথায়?
কোনোদিনও দাঁড়াতে পারবে অজন্তার গুহাচিত্র আর ইলোরার স্থাপত্যের সামনে?
সাংস্কৃতিক শিকড়ের নিরিখে যে সভ্যতা
প্রকৃতির সাথে সখ্যতা করে টিকে ছিল ১০ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে,
আজ সেই সভ্যতাই বাঁচতে শিখে গেছে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে।
প্রযুক্তি ও নতুন দাসত্বঃ
তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে ভারত নিঃসন্দেহে
আজ বড় শক্তি হয়ে উঠেছে,
কিন্তু প্রশ্ন এখানেই যে, “এটাই কি আসল অগ্রগতি?
না কি শুধুমাত্র প্রযুক্তির শৃঙ্খলে বাঁধা এক নতুন দাসত্ব?”
কারণ তথ্য ভাণ্ডার থাকলেও,
অন্তর্জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
প্রশ্ন করার স্বাধীনতা হারানোঃ
এক সময়ের ভারত, যেখানে প্রশ্ন করা ছিল ধর্মীয় কাজের সমান পবিত্র,
সেই ভারত আজ প্রশ্নকেই
করে অপরাধ, আর প্রশ্নকর্তা?
দাগী আসামী।
আর এখানে দাঁড়িয়ে তৈরি হয় ইতিহাস ও বর্তমানের সেতু:
অতীত ভারত ছিল অনুসন্ধিৎসা ও আলোয় ভরা;
আর বর্তমান ভারত?
উন্নয়নের মোড়কে এক ছায়াময় প্রতিচ্ছবি।
আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাঃ
তাহলে কি সত্যিই আশা নেই?
না আছে।
আশা আছে তখন’ই,
যখন- একজন ছাত্র গুগুল সার্চের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে
খুঁজবে নালন্দার আলোয় ফেরার পথ।
আশা আছে-
যখনই একজন মানুষ কংক্রিটের ফ্ল্যাটে থেকেও প্রয়াস নেবে গাছ লাগাবার।
আশা আছে-
যখনই আমরা শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতা স্মরণ করি।
কালের চাকা ঘুরছে,
প্রশ্ন শুধু একটাইঃ
আদৌ কি আমরা সেই আলোর পথে আর ফিরতে পারবো কোনোদিন?
বিবর্তনের যাঁতাকলে পিষে যে আলোকে আমরা হারিয়েছি নিজ অবহেলায়,
নিজ হাতে, খুঁজে কি পাবো সেই আলো?
না কি নিজেদেরকে ডুবিয়ে রাখবো এই ডিজিটাল অন্ধকারেই?
অতীত আমাদের শিখিয়েছে,
সভ্যতা টিকে থাকে শুধু উন্নয়ন দিয়ে নয়,
প্রকৃতি, জ্ঞান আর মানবতাকে সঙ্গে নিয়েই।
যদি আমরা আর কোনও দিনও
ফিরতে নাই পারি আমাদের সেই আলোয়-
তবে নালন্দার আত্মা কেবলই রয়ে যাবে
ডিজিটাল ক্লাউডে ঝুলন্ত এক স্মৃতি হয়ে!!
তন্ময় সিংহ রায়
One comment
Pingback: আর্যভট্টঃ প্রাচীন ভারতের মহান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী