অনন্ত মহাবিশ্ব ও মানুষের প্রশ্নঃ
নিভে যাওয়া আকাশের নিচে আমাদের প্রশ্ন একটাই-
ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকা এই অনন্ত মহাবিশ্বে,
আমরা কি সত্যিই একা?
বিজ্ঞানীরা উত্তর খুঁজে চলেছেন বিনিদ্র রাত ও দিন।
পাচ্ছেন শুধুই গভীর নীরবতা।
কোটি কোটি নক্ষত্র, হাজারো সম্ভাব্য সভ্যতা,
তবুও শূন্যতার ভিতরেই প্রতিধ্বনিত হয় এক নাম-“The Great Silence!”
বিজ্ঞান, গবেষক মাধ্যম থেকে প্রশ্নটা আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছে,
নিচ্ছে লক্ষ-কোটি বার, কিন্তু উত্তর? আজও অধরা।
মহাবিশ্বে প্রাণের সম্ভাবনাঃ
নিভে যাওয়া আকাশে জ্বলে লক্ষ লক্ষ তারা।
প্রত্যেকটা তারাই একেকটা সূর্য, আর প্রতিটা সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলেছে একাধিক গ্রহ।
এদের মধ্যে অনেক গ্রহতেই থাকতে পারে পৃথিবীর মতন আলো, বাতাস ও জলের অস্তিত্ব।
তাহলে প্রশ্ন :
“এই সীমাহীন মহাবিশ্বে কি কেবল আমরাই?”
এই প্রশ্ন কিন্তু মহাকাশবিজ্ঞানের সবচেয়ে সিনিয়র।
আর মাত্রাতিরিক্ত এক দ্বিধা এখানে যে :
যদি সম্ভাবনা থেকে থাকে এতই বেশি, তবে নিস্তব্ধতা এত গভীর কেন?
এত কথাই বা বলে কেন?
আর এই নীরবতাকেই বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন যে ডাক নাম :
“The Great Silence.”
ফার্মির প্রশ্ন ও ফার্মি প্যারাডক্সঃ
নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একজন পথপ্রদর্শক, ইতালীয় পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি 1950 সালে লাঞ্চ করতে করতে একবার বলেছিলেনঃ
“They should be here. So where are they?”
এই এক প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় “Fermi Paradox.”
মহাবিশ্বের আকার এত বিশাল, প্রাণের সম্ভাবনাও এত বেশি,
তবুও কোনও সংকেত নেই, কেউ আসছে না, কেউ যোগাযোগও করছে না।ফার্মির প্রশ্ন আজও অনুরণিতঃ
‘এত মহাকাশ, এত তারা, তবুও এত নিঃসঙ্গতা কেন?’
( আচ্ছা একটা প্রশ্ন কি মাথায় সাধারণত কখনও আমাদের এসেছে?
Tower Of London- এর Jewel House- এ রাখা আছে ভারত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী যে “কোহিনূর” হীরে-
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা যখন প্রশ্ন করে এই হীরের ইতিহাস নিয়ে, কি উত্তর দেয় কর্তৃপক্ষ?
প্রকৃত ইতিহাসকে প্রত্যেক মুহূর্তে নির্লজ্জের মতন কবর দিয়ে এরা আজও উত্তর দেয়-
“Symbol Of Conquest” অর্থাৎ- “জয়ের বা দখলের প্রতীক!”
এ নিয়ে পড়তে পারেন নিচের লেখাটা ক্লিক করেঃ )
“কোহিনূর থেকে ধানক্ষেত, ঔপনিবেশিক ডাকাতদের সেই প্রায় ১৯০ বছর!”
ড্রেক সমীকরণ ও SETI প্রকল্পঃ
“ড্রেক সমীকরণ” দিয়ে আমরা প্রাণের সম্ভাবনা হিসেব করে জানতে পারি,
কেবল আমাদের গ্যালাক্সিতেই থাকতে পারে হাজার হাজার বুদ্ধিমান সভ্যতা।
আর গোটা মহাবিশ্বে? বিলিয়ন বিলিয়ন সভ্যতা।
তাহলে তাঁরা কোথায়?
তাঁরা কি আদৌ দেখছে না আমাদের?
না কি আমরাই জানতে, বুঝতে পারছিনা তাঁদের ভাষা?
সেই 1960 সাল থেকে SETI (Search For Extraterrestrial Intelligence) প্রকল্প লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহাজাগতিক যে কোনো সংকেত ধরতে।
বিজ্ঞানীরা জায়েন্ট রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে শুনে চলেছেন কোথাও কোনও “Hello!” ভেসে আসছে কি না?
কিন্তু না, শুধুমাত্র অপেক্ষা, কবে? কোন দিন? কখন?
তা কেউ জানি না।
সেই 1977-এ ধরা পড়েছিল একটাই সিগন্যাল, “WOW…!
তবে আর কখনও ফিরে আসেনি সেটা, এরপর ফিরে এসেছে শুধুই নিঃস্তব্ধতা!
গ্রেট সাইলেন্স ব্যাখ্যার বিভিন্ন তত্ত্বঃ
Great Silence-কে ব্যাখ্যা করতে এদিকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন তত্ত্ব :
- ১. তাঁরা নেই- আমরা একাই।
- ২. তাঁরা আছে- কিন্তু বহু দূরে।
- ৩. তাঁরা আছে- কিন্তু ইচ্ছে করেই নীরব।
- ৪. তাঁরা এত উন্নত য, আমাদের চিনতেই পারছে না
বা নেই কোনও মিনিমাম আগ্রহ। - ৫. সব সভ্যতাই একদিন শেষ হয়ে যায় নিজেদের আবিষ্কারে।
এর কোনটা যে সত্যি?
জানে না কেউ, তবে প্রত্যেকটাই কিন্তু বেশ ভয়ের, আর গভীরও।
জু হাইপোথিসিস ও পর্যবেক্ষণঃ
“Zoo Hypothesis”– এক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা যেন কাঁচের ঘরের মধ্যে থাকা প্রাণী।
আর মহাজাগতিক উন্নত সভ্যতারা বাইরে থেকে দেখছে আমাদের, কখন আমরা তৈরি হব কথা বলার মতন?
তাঁরা হস্তক্ষেপ করছে না, সম্মান করছে আমাদের ‘স্বাধীন বিকাশ’-কে।
কিন্তু এটা যদি সত্যি হয়, তবে আমরা আছি পর্যবেক্ষণের অধীনে,
যা আরও ভয়ঙ্কর।
আরেকটা কারণ হতে পারে ‘সময়,’ কারণ একটা সভ্যতা হয়তো জন্ম নেয় ১০০০ বছর টিকে থাকার জন্যে, এরপর বিলুপ্ত।
আমরা খুঁজছি ঠিক সেই সময়ে, যখন কেউ নেই, অর্থাৎ সব শেষ।
আবার সম্ভবত আমরা সবাই ছুটছি নিজের নিজস্ব সময়রেখায়, কিন্তু কখনও মেলেনি কারও সঙ্গে।
হতে পারে এও, হয়তো আমরা খুঁজছি ভুল মাধ্যমে, খুঁজছি রেডিও তরঙ্গে, শব্দের ব্যাখ্যায়-
আর তাঁরা হয়তো ব্যবহার করছে কোয়ান্টাম সংকেত কিংবা ডার্ক এনার্জির ভাষা, বা এমন কিছু, যা চলে আমাদের প্রযুক্তির মাথার বহু গুণ উপর দিয়ে।
একজন আদিম মানুষ যেমন বোঝে না মোবাইল সিগন্যাল,
আমরাও হয়তো ঠিক তেমনই।
মহাজাগতিক আত্মহত্যাঃ
এবারে আমরা জানবো “মহাজাগতিক আত্মহত্যা” বা
“The Great Filter”– এর ভয়ঙ্কর সেই ব্যাখ্যা :
প্রতিটা সভ্যতা যখনই আবিষ্কার করে প্রযুক্তি, একসময় তা ধ্বংস করে ফেলে নিজেকেই, যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমা, AI বা জলবায়ু সংকটের মাধ্যমে।
তাহলে হয়তো আমরা এখনও সেই Filter- এর আগেই আছি অথবা পার হয়ে গেছি।
আর এই দুই ক্ষেত্রেই রয়ে যায় ভয়াল নিরবতা।
অনেকেই দাবি করে বা বলে থাকেন, এটা কল্পনা, এলিয়েন নেই,
কিন্তু কল্পনাও জন্ম নেয় সত্যের সম্ভাবনা থেকে।
যখন এতগুলো তত্ত্ব, এত গবেষণা, তখন নিশ্চই লুকিয়ে আছে এর পিছনে বাস্তব কিছু প্রশ্ন।
আকাশের প্রতিটা নক্ষত্র যেন সমানে প্রশ্ন করে চলেছে,
“তোমরা কি একা? না কি আমরাই এখন একা তোমাদের মতন?”
সাইলেন্ট ট্রিট্রি ধারণাঃ
তবে এমনও হতে পারে, কেউই চায় না নিজেদের কথা জানাতে।
সব সভ্যতাই হয়তো রাখে নিজের অস্তিত্ব গোপন।
ভয়ের কারণে, রক্ষণশীলতার কারণে বা কৌশলগত কারণে।
এটা যদি হয় এক মহাজাগতিক “Silent Treaty”– তবে আমরা কিন্তু এক নিষিদ্ধ অঞ্চল, যেখানে নতুনরা এলেই কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করে চুপ করে যেতে হয়।
বিজ্ঞান ও সাহিত্য জগতে প্রতিধ্বনিঃ
এই “Great Silence” নিয়েই আবার সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য কল্পবিজ্ঞানের গল্প।
Carl Sagan-এর “Contact” থেকে শুরু করে Arthur C. Clarke-এর
“Rendezvous With Rama,”
সব ঘুরে ফিরে আঙুল তোলে এই নিস্তব্ধতা নিয়েই।
বিজ্ঞানের মতই সাহিত্যেরও প্রশ্ন সেই একই, “এত শূন্যতা কেন?
কেন এত অন্ধকার?”
James Webb Space Telescope, Breakthrough Listen,
এমনই আরও অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি অবিরত খুঁজে চলেছে,
একটা সংকেত, একটা শব্দ বা একটা আলো, যা বদলে দিতে পারে বহু কিছু।
হতে পারে তা আমাদের জন্যে ভবিষ্যৎ বিপদের এক সবচেয়ে বড় কারণও।
হয়তো আগামী দশকেই আমরা পাব কোনও সাড়া।
তখন Great Silence যাবে চিরকালের মতন ফুরিয়ে ,
নতুনভাবে সৃষ্টি হবে শুধুই বিস্ময়ের দুর্ভেদ্য ও গহীন জঙ্গল!
অস্তিত্বগত প্রশ্নঃ
মহাবিশ্ব হয়তো চুপ, আবার হয়তো মহাবিশ্ব গর্ভের সেই সংকেতে আমরা বধির।
এটা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নয়, বরং আজ তা রীতিমতন এক অস্তিত্বগত প্রশ্নঃ
“এই অনন্ত ও রহস্যঘন মহাবিশ্বে আমরা কি একা?
না কি ভবিষ্যতে লুকিয়ে বসে আছে এক এমন উত্তর, যার কল্পনাও
এখনও আমরা পারিনি করে উঠতে?”
আমরা যদি সত্যিই একা হই, তবে এই বিশালতা শুধুই আমাদের,
আর যদি না হই,
তবে একদিন আমরা নিশ্চয়ই শুনবো দূর কোনো এক স্থান থেকে ভেসে আসা সেই শব্দ, “Hello…! ”
তন্ময় সিংহ রায়
Nice
Thank You.