কোহিনূর থেকে ধানক্ষেত, ঔপনিবেশিক ডাকাতদের সেই প্রায় ১৯০ বছর!

যে ডাকাতি শুধু সম্পদ নয়,

ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভারতবাসীর মর্যাদাও!

আচ্ছা একটা প্রশ্ন কি মাথায় সাধারণত কখনও

আমাদের এসেছে?

Tower Of London- এর Jewel House- এ রাখা আছে ভারত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী যে “কোহিনূর” হীরে-
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা যখন প্রশ্ন করে এই হীরের ইতিহাস নিয়ে, কি উত্তর দেয় কর্তৃপক্ষ?

প্রকৃত ইতিহাসকে প্রত্যেক মুহূর্তে নির্লজ্জের মতন কবর দিয়ে এরা আজও উত্তর দেয়-
“Symbol Of Conquest” অর্থাৎ, “জয়ের বা দখলের প্রতীক!”

কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বলে- পাঞ্জাবকে হাতের মুঠোয় নেবে বলে ‘লাহোর চুক্তি’-এর মতন কৌশলগত রাজনৈতিক চালকে কাজে লাগিয়ে এরা জোরপূর্বক কোহিনূর হীরেকে “ধারা- ৩ অনুযায়ী :
(“The gem called the Koh-i-Noor…shall be surrendered…to the Queen of England.”) তুলে দেয় রানী ভিক্টোরিয়ার মুকুটে।

দীর্ঘ প্রায় দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসঃ

দীর্ঘ প্রায় দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসের গর্ভ থেকে সংক্ষেপে আজ তুলে ধরার চেষ্টা করবো ভারতকে সর্বশান্ত করা, ব্রিটিশদের ভিতরে যত্নে বসবাস করা কদর্য সেই রূপ, যা আগাগোড়াই ঢাকা থাকত কোট দিয়ে।

ভারত স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই,
কিন্তু স্বাধীনতার প্রতিটা নিঃশ্বাসে আজও করুণ ও মর্যাদাহীনভাবে বেঁচে আছে এক দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী লুণ্ঠনের কদর্য ইতিহাস।

ব্রিটিশ শাসনের আসল রূপঃ

সাধারণত আমরা জানি ব্রিটিশ শাসন কেবল সীমাবদ্ধ ছিল জমি দখল বা কর আদায়ের মধ্যেই, কিন্তু না।
এ ছিল ভারতের বুকের মাঝখানে বসে এক সুপরিকল্পিত,
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক রক্তক্ষরণ।

ভারতের প্রাচীন শিল্প-বাণিজ্যের পতনঃ

পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমরা হারিয়েছিলাম বিশ্বের প্রাচীনতম শিল্প-বাণিজ্যের আত্মবিশ্বাস।
সূক্ষ্ম মসলিন, যার বুনন ভেদ করতে পারত সূর্যালোক,
তা ব্রিটিশরা কেটে টুকরো টুকরো করে নষ্ট করেছিল এমনভাবে,
যাতে ভারতীয় তাঁতশিল্প চিরতরে মুখ থুবড়ে পড়ে ধ্বংসের করাল গ্রাসে।

গোটা বঙ্গদেশের সোনালী ফসলের ভাণ্ডার রপ্তানি করে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল দুর্ভিক্ষ, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া এক তৃতীয়াংশ বাঙালি এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে এটা ছিল না, তা আজ আমরা জেনে গেছি অনেকেই, এ ছিল এক সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক লুণ্ঠনের কুফল।

( Area-51″ কি শুধুই পৃথিবীর সবচেয়ে গোপনীয়
ও Restricted সামরিক ঘাঁটি, না কি ভিনগ্রহীদের গোপন ডেরা?
এ নিয়ে জানতে হলে পড়তে পারেন নিচের লেখাটা। )

“এলিয়েন কি তবে পৃথিবীতেই আছে?”

দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর ইতিহাসঃ

এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে দেখা দেয় একের পর এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ , যার কিছু দুর্ভিক্ষে খরা বা বন্যার মতন প্রাকৃতিক কারণ ছিল ঠিকই,
কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসনের কঠোর করনীতি, খাদ্য রপ্তানি ও ত্রাণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অবহেলা মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে।
ইতিহাস বলছে এদের এই নীতিগত ভুলের কারণে প্রাণ হারিয়েছিল কোটি কোটি মানুষ।

লুটপাটের নিদর্শনঃ

ব্রিটিশ জাদুঘরে আজও দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস,
“কোহিনূর,” ‘দারিয়া-ই-নূর,’ ‘পিকক থ্রোন,’ যা একদিন ছিল দিল্লির গৌরব,
আর এখন, লণ্ডনের প্রদর্শনী।

শুধু রত্ন বা ধাতু নয়, ব্রিটিশরা নিয়ে গেছে প্রাচীন শাস্ত্র, গোপন চিকিৎসাবিদ্যা, মহাকাশ ও স্থাপত্যের নথি, যার কিছু আবার এরা নিঃসঙ্কোচে দাবি করে নিজেদের আবিষ্কার বলে।

মৌলিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও চলেছে যথাসম্ভব লুটপাট।
উদাহরণস্বরূপ রকেট প্রযুক্তির প্রাচীন ভারতীয় ব্যবহার (টিপু সুলতানের সেনাবাহিনী) নিয়ে গিয়ে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইউরোপীয় যুদ্ধনীতিতে।

ভারতের সম্পদ শোষণঃ

শিল্প বিপ্লবের জ্বালানি হয়েছিল ভারতের কাঁচামাল হিসেবে কাপাস, নীল, লোহা, চা, মশলা,
অথচ এই কাঁচামালের প্রকৃত মূল্য ভারতীয় কৃষকদের কখনও দেওয়া তো হয়ইনি, বরং তাঁদের গলা ধরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল ঋণ, কর ও দুর্দশার ঘন পাঁকের মধ্যে।

ব্রিটিশদের-
ভারতীয় মশলা, শিল্প, ধাতু, আবিষ্কার, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পুঁথি, সুর, সংগীত, বিজ্ঞান, শাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি লুটের কয়েকটা ধাপ এখানে উল্লেখ করা হল :

মশলা বাণিজ্যে দখলের নিদর্শনঃ

  • ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বাণিজ্যের নামে শুরু করে মশলা কেনা।
  • পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় রাজাদের সাথে চুক্তি ও কর আরোপে তাঁদের আনে নিয়ন্ত্রণে।
  • এরপর দাম চাপিয়ে চাষিদের বাধ্য করা হয় শুধুমাত্র রপ্তানিযোগ্য মশলা চাষ করতে।
  • পরবর্তীতে সমুদ্রপথ দখল করে সেই মশলা সরাসরি পাঠাতে থাকে ইউরোপে।
  • ফলে ভারতীয় বাজারে ক্রমশঃ কমতে থাকে মশলা, দুর্দশা বাড়ে চাষি থেকে সাধারণ মানুষের, পাশাপাশি সমৃদ্ধ হয় ব্রিটেন।

অর্থনীতি ও শ্রম শোষণঃ

নদী ও বন্দর ব্যবস্থা ব্রিটিশরা নিজেদের বাণিজ্যের সুবিধার্থে পুনর্গঠন করেছিল,
যার ফলে ভেঙে পড়েছিল স্থানীয় মৎস্য শিল্প।

চা শিল্পের উত্থান হয়েছিল চীনের পরিবর্তে ভারতের শ্রমিকের রক্ত দিয়ে,
আসামের জঙ্গলে জোরপূর্বক শ্রমে গড়ে উঠেছিল যে বাগান, এর মালিকানা কখনও আসেনি ভারতীয়দের হাতে।

খনিজ সম্পদের মাটি কেটে ব্রিটিশরা নিয়েছে সোনা, রূপা, কয়লা, মাইকা-
যার লাভ গেছে ব্রিটিশ স্টক এক্সচেঞ্জে, অথচ খনি-শ্রমিকের ভাগে ছিল মৃত্যুকূপ।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক লুণ্ঠনঃ

শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এরা যথাসম্ভব শুষে নিয়ে গেছে মেধা :
ভারতীয় গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের কাজ, আবিষ্কার বেমালুম কপি করে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিতে ছাপিয়ে বানিয়েছে পশ্চিমা আবিষ্কার বলে।

মন্দির ও স্থাপত্যের ভাস্কর্যগুলোও এরা কেটে সরিয়ে নিয়েছিল,
যেগুলো আজও বন্দী ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্ধকার কাঁচের ঘরে।

বাংলা ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার বহু পুঁথি ও পান্ডুলিপি পাচার করা হয়েছিল বিদেশে, যার মধ্যে ছিল এমন কিছু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, যা আজও ফিরতে পারেনি নিজ জন্মভূমিতে।

কম আলোচিত হলেও ব্রিটিশদের দ্বারা আর এক লুন্ঠন হল সংগীত ও সুরের।
ভারতের ধ্রুপদীর আগের নোটেশন নিয়ে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা হয়েছে ইউরোপীয় symphony তে, অথচ আজও কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি আমাদের উৎসকে, আর মিনিমাম কৃতজ্ঞতা?
সে তো আমাদের গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে।

 

( নিভে যাওয়া আকাশের নিচে আমাদের প্রশ্ন একটাই-
ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকা এই অনন্ত মহাবিশ্বে,
আমরা কি সত্যিই একা?
এ নিয়ে পড়তে পারেন নিচের লেখাটাঃ )

“এই অনন্ত মহাবিশ্বে তবে কি আমরা একা?”

ভাঙা হয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডকেঃ

ভারতের আত্মনির্ভর অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়ে, ব্রিটিশরা ভারতকে বানিয়ে ফেলেছিল, আমদানি নির্ভর এক দেশ।
ফলে দেশ স্বাধীন হলেও, শিল্প পুনর্গঠন ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

নৌবাহিনী ও জাহাজ শিল্প, যা এক সময় গুজরাট ও বাংলায় ছিল ভীষণ সমৃদ্ধ, তা ব্রিটিশরা ধ্বংস করেছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে সমুদ্র বাণিজ্যে ভারত কখনো আর প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে না পারে।

ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলেছিল যে, কেবল দীনমজুর, কেরানি এসব তৈরির কারাখানা গড়ে ওঠে দিকে দিকে, কোনও সৃজনশীল, বিজ্ঞানী বা উদ্যোক্তা নয়।

ব্রিটিশরা লুণ্ঠন চালিয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানেও-
যেখানে মশলা ও ঔষধি গাছের বীজ বিদেশে নিয়ে গিয়ে বেমালুম চাষ করা হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশে,
ফলে ভারত হারিয়েছে প্রাকৃতিক বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিকার।
উৎকৃষ্ট এক উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতেই পারে বঙ্গোপসাগরের লবণ, যা ছিল সস্তা ও সহজলভ্য।
এর উপরে কর চাপিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল গরিব মানুষের লবণ খাওয়ার অধিকার।

আরও ব্যতিক্রমী লুন্ঠন ছিল সাংস্কৃতিক মনোবৃত্তির, যা ভারতের নিজস্ব ইতিহাসকে বিকৃত করে এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছিল, যে পশ্চিমা শাসনই যেন হয়ে ওঠে সভ্যতার সূচনা।

ভারতীয় স্বাধীনতার অসম্পূর্ণতাঃ

১৫ ই আগস্ট, একজন অকৃত্রিম দেশ প্রেমি হিসেবে জেগে ওঠে আমাদের প্রতিদিনের মনে রাখার মতন সেইসব ইতিহাসের কালো দিক।
পতাকা উড়লেই, যা মনে করিয়ে দেয়, ব্রিটিশদের লুন্ঠনের সেই জীবন্ত ক্ষত আমাদের এখনও ভরেনি, যেন রক্ত ঝরছে সমগ্র বুক জুড়ে!

১৫ ই আগস্ট তাই কেবল রাজনৈতিক মুক্তির স্মারক নয়;
এটা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক লুণ্ঠিত স্বাধীনতা পুনর্দখলের অটুট শপথেরও দিন।
যতদিন না হারানো সম্পদ ও মর্যাদা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারছি-
ততদিন স্বাধীনতার উদযাপন থেকে যাবে অসম্পূর্ণই!!

 

তন্ময় সিংহ রায়

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলঃ মায়ামি, হ্যামিলটন, সান হুয়ানের ত্রিভুজ। গভীর সমুদ্রে রহস্যময় স্টার গেট, জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল– সমুদ্রের অদৃশ্য রহস্য ত্রিভুজ!

রহস্যের সামনে নির্বাক সভ্যতাঃ পৃথিবী– এর গর্ভে আজও যে কত বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *