ডার্ক ম্যাটার রহস্যঃ
মহাবিশ্বের অদৃশ্য শক্তির সন্ধানে।
কি এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি?
কেনই বা এরা বিজ্ঞান ও দর্শনের সবচেয়ে
ভয়ঙ্কর রহস্য হয়ে আমাদের সামনে আজও
দাঁড়িয়ে?
দৃশ্যমান বনাম অদৃশ্য মহাবিশ্বঃ
নরাতের আকাশে আমরা যে তারা, গ্রহ, গ্যালাক্সি দেখি,
মনে হয় এটাই বুঝি মহাবিশ্ব।
অথচ বাস্তবটা একেবারেই ঠিক উল্টো।
আধুনিক পর্দাথবিজ্ঞানের হিসেব অনুযায়ী- দৃশ্যমান পদার্থ মহাবিশ্বের মোট অংশের মাত্র ৪.৯ থেকে ৫%.
বাকি সবকিছু- যা আমরা চেয়েও দেখতে পাই না, মাপতে পারি না,
তাই হল মহাবিশ্বের সবথেকে বড় রহস্য, আর সেই দুই রহস্যের নায়ক হল-
“ডার্ক ম্যাটার” ও “ডার্ক এনার্জি।”
এরা একসাথে নিয়ন্ত্রণ করে মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫ থেকে ৯৬%,
অথচ এদের স্বভাব-চরিত্র, প্রকৃতি এর প্রায় কিছুই আমরা জানি না।
ডার্ক ম্যাটার: এক অদৃশ্য ভরের দানব।
গ্যালাক্সির ঘূর্ণন ধাঁধা :
১৯৩০-এর দশকে সুইস জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুইকি লক্ষ্য করেন,
গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের তারাগুলো এমন গতিতে ঘুরছে যে,
দৃশ্যমান ভর দিয়ে এদের ধরে রাখা সম্ভব নয়।
এর ঠিক পরেই ১৯৭০-এর দশকে ভেরা রুবিন, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনবেগ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন- তারাদের কক্ষপথে কাজ করছে এক অদৃশ্য ভর।
বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা যায়:
- আলো শোষণ বা বিকিরণ করে না, তাই অদৃশ্য।
- শুধু মহাকর্ষীয় প্রভাব দিয়েই ধরা যায়।
- মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৭% এর দখলে।
(প্রথম পৃথিবী ছিল এক প্রলয়চক্র।
৬০০০°c বা এর বেশি তাপমাত্রায় গোটা গ্রহ ছিল গলিত শিলার মহাসমুদ্র।
পৃথিবীর কোন সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আজ আমরা এসে দাড়িয়ে এই জায়গায়,
এই নিয়ে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে লেখাটা পড়তে পারেনঃ)
“পৃথিবীর সৃষ্টি ইতিহাসঃ ৪.৬ বিলিয়ন বছরের এক মহাকাব্যিক যাত্রা!”
তত্ত্ব:
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ডার্ক ম্যাটার হয়তো কোনও অজানা মৌলিক কণা (WIMPs, axions) দিয়ে তৈরি।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভূগর্ভস্থ ল্যাবে এগুলোকে চেষ্টা করা হচ্ছে ধরার,
কিন্তু এখনও এর চুড়ান্ত কোনো প্রমাণ নেই।
ভয়াবহতা:
ডার্ক ম্যাটার যদি না থাকত,
গ্যালাক্সি ছিঁড়ে যেত এক মুহূর্তেই,
অর্থাৎ আমাদের অস্তিত্বই নির্ভর করছে এক দৃশ্যহীন “কসমিক আঠা”-এর উপরে, যাকে আমরা না দেখতে পাই চোখে, আর না পারি স্পর্শ করতে।
ডার্ক এনার্জি: ত্বরিত বিস্তারের রহস্য।
মহাবিশ্বের ত্বরিত সম্প্রসারণ :
১৯৯৮ সালে দু’দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী (Perlmutter, Schmidt, Riess)
সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়ে যান, তাঁরা লক্ষ্য করেন,
মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিত হচ্ছে তা নয়, বরং পাশাপাশি বেড়ে চলেছে এর গতিও।
বলা বাহুল্য এ আবিষ্কারের জন্যে ২০১১-তে তাঁরা পেয়ে যান “নোবেল” পুরষ্কারও।
এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি,
“সুপারনোভা” হল কোনও বিশাল নক্ষত্রের জীবনের শেষে এক ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ বিস্ফোরণ,
যেখানে মুক্তি পায় এর ভিতরের শক্তি।
এই বিস্ফোরণে মৃত নক্ষত্রটা হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল,
আর নতুন উপাদান হিসেবে ছড়িয়ে দেয় মহাকাশে।
কি এই শক্তি?
ডার্ক এনার্জি হল এক অজানা, অচেনা শক্তি,
যা কাজ করে মহাকর্ষের বিপরীতে এবং সবকিছুকে দেয় দূরে ঠেলে।
মহাবিশ্বের ৬৮ থেকে ৬৯% এর নিয়ন্ত্রণে।
এটা হয়তো ভ্যাকুয়াম এনার্জির ফল,
আবার কেউ মনে করেন পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সমীকরণ অসম্পূর্ণ।
ভয়াবহ সম্ভাবনা :
যদি ডার্ক এনার্জি ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হয়, মহাবিশ্ব “বিগ রিপ”
নামের এক মহাপ্রলয়ে পড়তে পারে ভেঙে।
আর ঠিক সে সময়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তারা, গ্যালাক্সি, এমনকি পরমাণুও।
কেন এরা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রহস্য?
১. হয়ে আছে অদৃশ্য, আমাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে, অথচ নিয়ন্ত্রণ করছে মহাবিশ্বের ৯৫%.
২. অস্তিত্বের প্রশ্ন যদি আসে, তো বলা যায়,
ডার্ক ম্যাটার ছাড়া ভেঙে পড়ত গ্যালাক্সি, আর ডার্ক এনার্জি ছাড়া মহাবিশ্ব নিত ভিন্ন এক রূপ।
৩. এদের প্রকৃতি, আচরণ বা স্বভাব না বোঝা মানে আমাদের পদার্থবিদ্যা লজ্জিত, অসম্পূর্ণ।
৪. তবে প্রশ্ন কি এখানে আসা স্বাভাবিক নয় যে-
আমরা কি সত্যিই মহাবিশ্বকে জানি?
না কি কেবলই স্পর্শ করছি এর ছায়া?
সমগ্র মানবজাতির সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ আজ এ রহস্য।
রহস্য উন্মোচনের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাঃ
লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার:
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কণা-ত্বরক,
যেখানে বিজ্ঞানীরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকে একে অপরের সাথে ধাক্কা দিয়ে
মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তে (Big Bang-এর সময়ে) কি ঘটেছিল, তা বোঝার চেষ্টা করেন।
কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড পর্যবেক্ষণ:
এটা হল মহাবিশ্বের জন্মের পর থেকে বেঁচে থাকা সবচেয়ে পুরানো আলো বা বিকিরণ।
বিজ্ঞানীরা এই কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন পরীক্ষা করে খোঁজেন
মহাবিশ্বের শুরুর দিকের গঠন আর বিস্তারের সূত্র।
ডার্ক এনার্জি সার্ভে:
এ এক বিশাল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্প,
যেখানে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ছবি তোলা হয় বিভিন্ন তারা ও গ্যালাক্সির।
উদ্দেশ্য- মহাবিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণের রহস্যময় কারণ,
কিভাবে কাজ করছে ডার্ক এনার্জি, তা সঠিকভাবে বোঝা।
আর এ সবের’ই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে অবিরাম।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও মানুষের সীমাঃ
হয়তো হতে পারে এও, বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসলস্বরূপ আগামী শতাব্দীতেই
আমরা আবিষ্কার করবো নতুন কণা,
বা খুলে যাবে নতুন পদার্থবিজ্ঞানের দরজা।
সে যাই হোক, এ রহস্য কিন্তু আমাদের মনে করিয়ে দেয়-
মানুষ মহাবিশ্বের মালিক নয়, কেবল অনুসন্ধানী যাত্রী মাত্র।
মানুষ সর্বদাই ভয় পায় অজানাকে,
কিন্তু সেই ভয়’ই জাগিয়ে তোলে আমাদের কৌতুহলকে।
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি হয়তো আজও অমীমাংসিত,
কিন্তু আগামী দিনের জ্ঞানের দিগন্তে এরাই সবচেয়ে বড় আলোকবর্তিকা।
একদিন হয়তো আমরা আবিষ্কার করে বসবো, মহাবিশ্বের এই অন্ধকার আসলে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি,
আমাদের অজ্ঞানতার সীমা।
ততদিন পর্যন্ত এ রহস্য আমাদের লাগাতার জানিয়ে যাবে চ্যালেঞ্জ,
আর আমরা প্রতিবার আকাশের দিকে অবাক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করবো-
আমরা কি সত্যিই জানি এই সীমাহীন মহাবিশ্বকে?
কতটুকু জানি?
ভবিষ্যতেও বা জানবো কতটুকু?
তন্ময় সিংহ রায়
One comment
Pingback: পৃথিবীর সৃষ্টি ইতিহাসঃ ৪.৬ বিলিয়ন বছরের এক মহাকাব্যিক যাত্রা!