পৃথিবীর সৃষ্টি ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে-
মহাজাগতিক ধূলো ও আগুনের ভিতর থেকে।
তখন নদী, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত বা প্রাণ ছিল না,
ছিল শুধুই বিষাক্ত গ্যাসে ভরা অস্থির গ্রহ।
ধীরে ধীরে আগুন থেকে জন্ম নিল জল,
আর জল মাধ্যমেই শুরু হয় জীবনের প্রথম শ্বাস।
অক্সিজেন বিপ্লব ও মহাদেশের ভাঙাগড়া তৈরি করল
আজকের নীলাভ পৃথিবী।
এই মহাকাব্যিক সৃষ্টি কাহিনীর শেষ অধ্যায় এখন লিখছে মানুষ-
আমাদের সভ্যতা।
প্রারম্ভিক পৃথিবীঃ
শুরুটা ছিল একেবারেই ভিন্ন।
তখন প্রকৃতিই ছিল মানুষের আশ্রয়, প্রকৃতিই ছিল জীবনের সঙ্গী।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সভ্যতার উন্নতিকে সাথে নিয়ে,
আজকের যে আধুনিক পৃথিবীতে আমারা বসবাস করি,
তা কংক্রিটের দেওয়ালে ঘেরা যান্ত্রিক পৃথিবী।
যেখানে বিশ্রাম, স্বপ্ন সবই সীমাবদ্ধ।
(এরা একসাথে নিয়ন্ত্রণ করে মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫ থেকে ৯৬%,
অথচ এদের স্বভাব-চরিত্র, প্রকৃতি এর প্রায় কিছুই আমরা জানি না।)
পড়ুনঃ “মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রহস্য!”
পৃথিবীর জন্মলগ্নে সবকিছু ছিল ভিন্ন।
শহর, গ্রাম, নদী, জলাশয়, গাছ বা পশু-পাখির একটুও অস্তিত্ব ছিল না।
ছিল শুধুই আগুনের দাদাগিরি ও ধূলোর সাম্রাজ্য।
কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও অ্যামোনিয়ায় ভরা বিষাক্ত বাতাসে চলছিল অস্থির মহাজাগতিক সংঘর্ষ।
এমনকি সেখানে অক্সিজেনও ভয় পেত জন্ম নিতে।
তবুও সেই বিশৃঙ্খলার বুক চিরে বেজে ওঠে এক সুর।
এই সুরে জন্ম নেয় আজকের এই শান্ত, সবুজ ও নীলাভ পৃথিবী।
আর সেই পৃথিবীতে-সমুদ্র, মহাদেশ, জীবন আর শেষ পর্যন্ত মানুষ।
পৃথিবীর ইতিহাস মানে কিন্তু শুধু বিজ্ঞান নয।
এটা এক মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটা অধ্যায় সৃষ্টির দিকে ক্রমশঃ এগিয়েছে,
মৃত্যুকে পেরিয়ে।
মহাজাগতিক গর্ভ থেকে পৃথিবীর জন্মঃ
প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে মহাজাগতিক ধূলো ও গ্যাসের মেঘ (সোলার নেবুলা)
সংকুচিত হতে থাকে।
মেঘের উপাদান ছিল ৭৪% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম ও ২% অন্যান্য ভারী মৌল,
যা সংকোচনের ফলে অত্যন্ত মাত্রায় বেড়ে যায় কেন্দ্রের তাপ ও চাপ।
সেই কেন্দ্রেই শুরু হয় হাইড্রোজেন পরমাণুর সংযোজন (নিউক্লিয়ার ফিউশন।)
ঠিক সে সময়েই জন্ম নেয় আমাদের “সূর্য।”
এরপর শুরু হয় আরেক বিশাল প্রক্রিয়া।
সদ্যজাত সূর্যের চারপাশে ছিল ধূলো ও গ্যাসের ভয়ানক ঘূর্ণন।
সেই ঘূর্ণায়মান গ্যাস-ধূলোর আলো-অন্ধকার মেঘে শুরু হয় মারাত্মক সংঘর্ষ, ভাঙাগড়া, মিলন এবং জন্ম।
ফলে ছোট ছোট সেই টুকরো মিলিত হয়ে তৈরি করে বৃহৎ প্রোটোপ্ল্যানেট।
ঠিক এই প্রক্রিয়ার শেষ অধ্যায়েই জন্ম নেয় পৃথিবী, মঙ্গল, বুধ ও শুক্রের মতন সব শিলাময় গ্রহ।
বাকি, বাইরের দৈত্য আকারের গ্যাসীয় গ্রহ, যেমনঃ বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস
ও নেপচুন জন্ম নিতে সময় নেয় একটু বেশি।
( যে ডাকাতি শুধু সম্পদ নয়,
ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভারতবাসীর মর্যাদাও।
পড়ুন ব্রিটিশদের ভারত শোষণের সেই নির্মম ইতিহাস।)
“কোহিনূর থেকে ধানক্ষেত, ঔপনিবেশিক ডাকাতদের সেই প্রায় ১৯০ বছর!”
পৃথিবী জন্মের কাহিনি শান্ত ছিল না মোটেই।
একসময় “থিয়া” নামে মঙ্গল আকৃতির এক গ্রহ বিধ্বংসী রূপ নিয়ে,
ভয়ঙ্করভাবে সজোরে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে,
আর ধ্বংসের সেই মুহূর্তেই গড়ে ওঠে আমাদের একমাত্র উপগ্রহ “চাঁদ।”
বিজ্ঞানীদের দাবি অনুযায়ী-
এই সংঘর্ষ ছিল পৃথিবীর জন্যে বর দান।
এই সংঘর্ষেই পৃথিবী পায় জীবনের ভিত্তির জন্য অপরিহার্য উপাদান-
জৈব অণুর কাঁচামাল হিসেবে কার্বন ও জলরূপে হাইড্রোজেন।
এভাবেই ধ্বংসের ভিতর থেকেই জন্ম নেয় বীজ,
যা একদিন প্রাণের সবুজে রূপ নেবে।
আগুন থেকে জলের সৃষ্টিঃ
প্রথম পৃথিবী ছিল এক প্রলয়চক্র।
৬০০০°c বা এর বেশি তাপমাত্রায় গোটা গ্রহ ছিল গলিত শিলার মহাসমুদ্র।
ভিতরের ম্যাগমা, ধোঁয়া আর বিষাক্ত গ্যাস বাইরের লাভার আগুনে মিশে এক জ্বলন্ত অগ্নিগোলক তৈরি করেছিল।
কেউ কি আমরা কল্পনা করতে পারি-
এই অগ্নিগর্ভ গ্রহের পেট থেকেই কোনও এক সময়ে শুরু হবে নতুন বিন্যাস?
লোহা, নিকেল এর মত ভারী উপাদানগুলো একসময়ে ডুবে যায় গভীরে,
তৈরি করে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বা কোর।
হালকা উপাদান, যেমনঃ সিলিকন, অক্সিজেন, অ্যালুমিনিয়াম,
সোডিয়াম ও পটাসিয়াম ভেসে উঠে গড়ে তোলে ক্রাস্ট বা ভূ-পৃষ্ঠ।
আর, না ভারী, না হালকা ঘনত্বের উপাদান,
যেমন: ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম মিলিত হয়ে গঠিত হয় ম্যাণ্টল(Mantle)স্তর।
সদ্যজাত পৃথিবীর বিভিন্ন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত-
কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, নাইট্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়া
ইত্যাদি গ্যাস মিলিত হয়েই তৈরি করে প্রথম বায়ুমণ্ডল।
বায়ুমণ্ডলে থাকা সেই বাষ্পই ঠাণ্ডা হয়ে অবাধে ঝড়ে পড়ে বৃষ্টি হয়ে।
বৃষ্টি অর্থে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে ভেসে ওঠে যে ধারণা,
এ কিন্তু সে বৃষ্টি আদৌ নয়- বলা যায় বৃষ্টির তাণ্ডবলীলা।
কোটি কোটি বছর ধরে সেই বৃষ্টি পূর্ণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন গর্ত, খাদ, অবনমন অংশ বা নিম্নভূমি।
ফলে প্রায় ৪৪০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্র, জলাশয়, হ্রদ ইত্যাদি গঠিত হয়।
পৃথিবীর স্তর ও গঠনঃ
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর স্তরকে দু’ভাবে ভাগ করেছেনঃ
রাসয়নিক গঠন অনুযায়ীঃ
(Composition Based Layers)
- কোর স্তরঃ (কেন্দ্রস্থল)
প্রায় ৮৫% লোহা, ৫-১০% নিকেল আর সামান্য সালফার, অক্সিজেন, সিলিকন, কার্বন ও হাইড্রোজেনের
মতন হালকা উপাদান দ্বারা গঠিত, যার পুরুত্ব প্রায় ৩,৫০০ কিমি। - ম্যাণ্টল স্তরঃ
কোরের উপরে থাকা বৃহত্তম স্তর, যার পুরুত্ব প্রায় ২,৯০০ কিমি।
এই স্তরের প্রধান উপাদান- অক্সিজেন, ম্যাগনেশিয়াম, সিলিকন ও লোহা
ও অল্প পরিমাণে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও অ্যালুমিনিয়াম। - ক্রাস্ট বা ভূ-পৃষ্ঠঃ
পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের স্তর, তুলনামূলকভাবে এটা বেশ পাতলা স্তর।
এই স্তর স্থলভাগে পুরুত্ব নিয়েছে গড়ে প্রায় ৩০-৫০ কিমি ও মহাসাগরের নিচে ৫-১০ কিমি।
পশু-পাখি, গাছপালা, নদী, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত ও মানুষ নিয়ে এই স্তরেই গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা।
ভৌত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীঃ
(Physical Properties Based Layers)
- লিথোস্ফিয়ার– কঠিন ক্রাস্ট + উপরের কঠিন ম্যাণ্টল।
- অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার– আংশিক তরল, স্লাইডিং লেয়ার।
- মেসোস্ফিয়ার– শক্ত ম্যাণ্টলের গভীর অংশ।
- আউটার কোর (বাইরের কোর)- তরল লোহা-নিকেল।
আর এখান থেকেই তৈরি চৌম্বক ক্ষেত্র। - ইনার কোর (ভিতরের কোর)-
কঠিন লোহা-নিকেল, সবথেকে ভিতরের স্তর।
পৃথিবীর শৈশব ও জীবনের প্রথম শ্বাসঃ
আজও পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে আছে এর শৈশবের স্মৃতি।
কানাডার Nuvvuagittuq Greenstone Belt-এর শিলা বলে দিচ্ছে ৪১৬ কোটি বছরের সেই ইতিহাস।
Acasta Gneiss নামে আরেক শিলার বয়েস প্রায় ৪০০ কোটি বছর।
এই শিলাগুলো ঠিক পৃথিবীর দিনলিপির মত
যেখানে লেখা আছে-
“আমি জন্মেছিলাম আগুনে আর আজও টিকে আছি কোটি কোটি বছর ধরে।”
অসীম জলে ডুবে থাকা পৃথিবী একসময় নিঃশ্বাস নেয় জীবনের।
বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন স্ট্রোমাটোলাইটস-
নীল-সবুজ শৈবালের তৈরি প্রাচীন জীবাশ্ম, যাদের বয়েস ৩৫০ কোটি বছর।
এমনকি, পুরানো শিলায় জীবনের প্রমাণ মিলেছে ৪১০ কোটি বছর আগেই।
এরা ছিল এককোষী অণুজীব, যারা সূর্যের আলো ব্যবহার করে, সালোকসংশ্লেষ
পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে শুরু করেছিল অক্সিজেন।
অর্থাৎ পৃথিবী খুব বেশিদিন অপেক্ষা করেনি।
আগুন থেকে জল, আর জল থেকে জীবন, এটাই ছিল এর স্বাভাবিক পরিণতি।
অক্সিজেন বিপ্লবঃ
প্রথম জীবেরা অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে ছিল।
প্রায় ২৪০ কোটি বছর আগে নীল সবুজ শৈবালই সূর্যের আলো ব্যবহার করে অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করে।
এভাবেই ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভরপুর হয়ে ওঠে অক্সিজেনে,
ঘটে Great Oxidation Event.
এটা ছিল জীবনের ইতিহাসে সব থেকে মহৎ বিপ্লব।
পরবর্তীতে এই অক্সিজেনই ভবিষ্যৎ প্রাণীদের নিঃশ্বাস আর মানুষের অস্তিত্বের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
(Area-51″ কি শুধুই পৃথিবীর সবচেয়ে গোপনীয়
ও Restricted সামরিক ঘাঁটি,
না কি ভিনগ্রহীদের গোপন ডেরা?
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কি আমদের বোকা বানিয়ে রেখেছে?
জানতে পারেন নিচের লেখাটা পড়েঃ)
“এলিয়েন কি তবে পৃথিবীতেই আছে?”
মহাদেশের ভাঙাগড়াঃ
পৃথিবী কখনো স্থির হয়নি-
এর বুকের নিচে প্লেট টেকটনিকস্ নৃত্য করে নিরন্তর।
পৃথিবীর প্রথম সুপারকন্টিনেন্ট হল Vaalbara.
এরপর Rodinia, Pannotia,আর সবশেষে Pangaea- যার প্রত্যেকটা তৈরি হয়েছে,
আবার গেছে ভেঙেও।
তবে Pangaea বা প্যাঞ্জিয়া ভেঙেছে আজ থেকে প্রায় ৩২০-২০০ মিলিয়ন বছর আগে।
এই ভাঙাগড়ার ইতিহাসেই জন্ম নিয়েছে পর্বত, মহাসাগর, উপত্যকা।
প্রকৃতির প্রত্যেকটা দৃশ্যপট আসলে পৃথিবীর অবিরাম পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।
মানুষ ও বর্তমান পৃথিবীঃ
এই দীর্ঘ ইতিহাসের শেষে আসে মানুষ।
মাত্র তিন লাখ বছর আগে ইতিহাসের পাতায় যোগ হয় মানুষের নাম,
যা কোটি কোটি বছরের এই ইতিহাসের তুলনায় একটা ছোটো মুহূর্ত মাত্র।
অথচ এই ক্ষুদ্র সময়ে মানুষ পুরো বদলে ফেলেছে পৃথিবীর রূপ।
সভ্যতা, নগর, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, শিল্প, দর্শন এ সবই সৃষ্টি করেছে মানুষ।
কিন্তু এই পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্রমশঃ বেড়েছে পৃথিবীর প্রতি মানুষের
দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা।
আজ মানুষের হাতেই রয়েছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, সাথে আমাদের অস্তিত্ব।
মানুষ কি জীবনকে রাখবে টিকিয়ে?
না ধ্বংসের মুখে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেবে?
পৃথিবীর ইতিহাস হল এক মহাকাব্য-
যেখানে প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয় বিশৃঙ্খলা দিয়ে আর শেষ হয় সৃষ্টিতে।
ধূলোকণার মেঘ থেকে সমুদ্র-
জীবনের প্রথম আলো থেকে অক্সিজেনের বিপ্লব।
মহাদেশের ভাঙাগড়া থেকে মানুষের জন্ম-
সবকিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছে আজকের এই নীলাভ সুন্দর বাসযোগ্য ও আপাতত একমাত্র এ গ্রহ।
এ কাহিনি তবে আমাদের কি শেখায়?
পৃথিবী শুধুমাত্র একটা গ্রহ নয়,
এটা সময়ের সুরে রচিত এক অন্তহীন কবিতা।
আর সেই কবিতার শেষ পংক্তি এখনও হয়নি লেখা।
কারণ সেই দায়িত্ব পৃথিবী অনেক আগেই দিয়েছে আমাদের হাতে।
পৃথিবী- এর ‘প্রকৃতি’ নামক কন্যাকে মানুষের হাতে করেছে দান।
এবারে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য আমরা দেব?
না চলবো এভাবেই বেপরোয়া ভাবে, আর হব অস্তিত্বহীন?
এর উত্তর আমরাই।
তন্ময় সিংহ রায়
One comment
Pingback: ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিঃ মহাবিশ্বের ৯৫% রহস্য যাদের দখলে।