নরকের সেই সকালঃ হিরোশিমা ও নাগাসাকি থেকে শিক্ষা!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নিঃশ্বাস

সাল ১৯৪৫–
পৃথিবী তখন রক্তে ভেজা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নিঃশ্বাস টানছে।
বন্দুকের শব্দ বেশ ক্লান্ত, কিন্তু ভারী আকাশে তখনও ধোঁয়ার গন্ধ।
কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, ইতিহাসের কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াল-ভয়ঙ্কর সকাল,
যার আলোয় জ্বলবে মানবতার ছাই।
মানব সভ্যতা এগিয়ে আসছে এমন এক দিন-এর দিকে,
যেখানে সূর্য আর আকাশে নয়, ফেটে পড়বে মাটির বুকে আগুন হয়ে।
আর মানুষ দেখবে নিজের বানানো নরককে।

হিরোশিমাঃ Little Boy-এর আগুন

৬ই আগস্ট, সকাল ৮.১৫–
জাপানের হিরোশিমাতে মৃত্যুর দূত হয়ে নেমে এল B-29 বোমারু বিমান,
যার পেট থেকে যেন নৃশংসভাবে আছড়ে পড়ল একটা ছোট ধাতব বস্তু– Little Boy.
৪৩ সেকেন্ড পর, এক মুহূর্তে বদলে গেল জাপানের ইতিহাস।

সেই বিস্ফোরণ খুলে দিল নরকের দরজা।
প্রথম ১ সেকেন্ডে তাপমাত্রা গিয়ে পৌঁছেছিল ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
মানুষের ছায়াও গলে গেছিল দেয়ালে।
গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি , অন্যান্য জীব-জন্তু নিমেষেই ভস্ম হয়ে গেল,
এমনকি বাতাসও পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
হিরোশিমা শহরের প্রায় ৭০% দেহ এক লহমায় পরিণত হল ধ্বংসস্তুপে।
আনুমানিক প্রায় ৮০,০০০ মানুষ তৎক্ষণাৎ অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
১৯৪৫ সালের শেষের দিকের হিসেব অনুযায়ী–
এরপর বিকিরণ ও তীব্র আঘাতে মোট মৃত্যুর সংখ্যাটা,
১,২০০০০ থেকে গিয়ে পৌঁছেছিল ১,৪০০০০ এর কাছে।
এভাবেই ধীরে ধীরে ও ক্রমে বেড়ে চলল মৃতদেহের সংখ্যা।

( পারমাণবিক যুদ্ধ– ধ্বংস কি শুধু মুহূর্তের?
পড়ুন– Click: মানবতার খনিতে আজও ইউরেনিয়ামের গন্ধ! )

নাগাসাকিঃ Fat Man-এর নরক

৯ই আগস্ট, সকাল ১১ টা ২ মিনিট–
এবার লক্ষ্য নাগাসাকি।
পারমাণবিক বোমা Fat Man, মানব সভ্যতার অভিশাপ হয়ে নেমে এল জাপানের কিউশ দ্বীপে।
এ বোমার বিস্ফোরণের শব্দ ছিল আগেরটার চেয়েও বেশি,
যাতে– শুধু শব্দের তীব্রতায় ছিঁড়ে যায় হাজার মানুষের কানের পর্দা।
গোটা উপত্যকা ঢেকে গেল জমকালো, বিষ ধোঁয়ার পুরু চাদরে।
চারিদিকে আগুনের উচ্ছৃঙ্খলতা, নিষ্ঠুরতা মুহূর্তে কেড়ে নিল ৪০-৭৫,০০০ মানুষের অযাচিত প্রাণ।
কেউ একফোঁটা জলের জন্যে হাহাকার করছিল,
কেউ তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আর্তচিৎকার করছিল।
রক্তাক্ত পরিবেশে সে দিনের আকাশ-বাতাস যেন আন্দোলিত হতে শুরু করেছিল।
এরপর বিকিরণ ও আহত মিলিয়ে সংখ্যাটা গিয়ে পৌঁছাল প্রায় ১০০,০০০ এর কাছে।

পারমাণবিক বোমার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

Little Boy ও Fat Man- শুধু তাণ্ডব চালায়নি,
এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছেড়ে গেছিল ভয়ঙ্কর বিকিরণ ও দীর্ঘমেয়াদি মৃত্যুর ছাপ,
যা আগামী ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে।
শুরু হয় বিকিরণজনিত রোগ–
থাইরয়েড, লিউকোমিয়া, হৃদপিণ্ডের সমস্যা, জন্মগত বিকৃতি ইত্যাদি।

পারমাণবিক প্রকল্পের বিজ্ঞানী ও Atom Bomb-এর পিতামহ,
বিজ্ঞানী J Robert Oppenheimer হিরোশিমায়,
পারমাণবিক বোমা ফেলার পর মন্তব্য করেছিলেন–
“Now I am become Death, the destroyer of worlds.”
Oppenheimer হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও ভারতীয় দর্শনের পাঠ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।

ভগবত গীতার ১১ অধ্যায়-এর ৩২ নং শ্লোকে লেখা আছে– 
“আমি কাল– বিশ্বের বিনাশকারী ; আমি এখানে এসেছি সকলকে ধ্বংস করার জন্য।
তোমাকে ছাড়া এখানে অবস্থান করা প্রতিপক্ষের সকল যোদ্ধাই বেঁচে থাকবে না।”
অর্থাৎ, যেখানে শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখান,
এবং সমস্ত প্রাণ, ও জীবন-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাঁর হাতেই।
ভগবত গীতার এই বাণীকে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে,
Oppenheimer
এই মন্তব্যটা করেছিলেন।

জ্ঞান ও শক্তির অভিশাপ

হিরোশিমা ও নাগাসাকির হৃদপিণ্ড কাঁপানো এই ঘটনায় মানুষ প্রথমবার বুঝলো,
জ্ঞান কখনও কখনও অভিশাপ হতে পারে।
মানুষ শিখলো– সভ্যতা যতই উন্নত হোক,
একটা ভুল সিদ্ধান্ত কিভাবে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ণ করে দিতে পারে গোটা মানবজাতিকে,
ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে সভ্যতার দম্ভকে।

সেই দুই সফেদ-কালো ছায়ার পরে পৃথিবী বদলে গেল, চোখ খুলল এক নতুন বিষাদে।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসস্তুপ না শুধু নগরের আকৃতিকে নষ্ট করেছিল,
বরং সময়ের ধারকেও খুলে দিয়েছে চেনা রঙ।
মানবসভ্যতার আত্মবিশ্বাস ভাঙার সেই শব্দ যেন দীর্ঘস্থায়ী কণ্ঠে কুহুক করে উঠল।
বেঁচে থাকা মানুষগুলো ছিল অতৃপ্ত স্মৃতির বহনকারী,
বিস্মৃতির গল্প নয়, রক্তমাংসে গাঁথা প্রমাণ।
তাঁদের কাঁধে লুকানো দগদগে ক্ষত, তাঁদের শরীরে জ্বলন্ত দাগ, তাঁদের চোখে ঘোরানো,
অব্যক্ত প্রশ্ন– “কেন?”

বিস্ফোরণের মুহূর্তে যারা পুড়ে গেল, তাঁরাই ছিল ভাগ্যবান।
যারা বেঁচে রইল, তাঁদের জীবনটা হয়ে উঠল ধীরগতির মৃত্যু।
বিকিরণ ও ক্ষত, ছোঁয়া থেমে যাওয়া সন্তানের কোল, জন্মগত অস্বাভাবিকতা,
আগামী অনেক বছর ধরে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠা ব্যথা, যন্ত্রণা।
হাসপাতালের বারান্দা জুড়ে, ছাই মেখা মুখ আর ভাঙা কানের মানুষগুলো,
নামহীন ভূতের মত ঘুরে বেড়াত।
ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ণ কখনও মুছে যায় না– তারা হয়ে ওঠে ইতিহাসের স্তম্ভ ;
সময় তাদের রূপান্তরিত করল সতর্কতার মুকুটে।

বিশ্বকে দেওয়া বার্তা

এই দুই বিস্ফোরণ কেবল জাপানী নয়, গভীর আঘাত করেছিল গোটা বিশ্বকে।
রাষ্ট্র বুঝল, জ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুকরণীয় নয় ;
তা যদি অসাবধানতা, লোভ বা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়,
তবে তা কেবল যুদ্ধের মাপকাঠি বদলাবে না, মানবসভ্যতার স্থায়ী রূপান্তর ঘটাবে।
পরবর্তীকালে পারমাণবিক শক্তির সম্ভাব্যতা ও বিনাশী ক্ষমতা নিয়ে,
বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় আগুন জ্বলে উঠল–
শীতল যুদ্ধের উষ্ণ ছায়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা রূপ নিল পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
মানবজাতি তৈরি করল এমন এক অস্ত্রভাণ্ডার,
যার ব্যবহার মানে সময়ের গহ্বর ভেঙে চিরতরে সব অন্তর ছিঁড়ে ফেলা।

হিবাকুশাদের প্রেরণা ও শিক্ষা

তবু প্রলয়ঙ্কর সন্ধ্যাবেলায় এক অদ্ভুৎ পরিণতি ঘটল,
আদিম মানবিকতা ফিরে পেল আরেকরকম কণ্ঠ।
হিরোশিমা-নাগাসাকির বেঁচে থাকা মানুষরা– হিবাকুশা,
তাঁরা কেবল ভুক্তভোগী নন ; হয়ে উঠলেন শান্তির দূত।
তাঁদের ব্যথা, স্মৃতি বারবার রাষ্ট্রপুঞ্জে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে, স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে পৌঁছাতে লাগল।
তাঁরা সাক্ষ্য দিলেন– জ্ঞান শুধু জয়ের হাতিয়ার নয়, এরও দায়িত্ব আছে ;
শক্তিকে যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, মানবসভ্যতার আশা ছাই হয়ে উড়ে যাবে।
শহরদুটোর ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়ানো স্মৃতিসৌধগুলো আজ শুধুই স্মরণ নয়– সতর্কবার্তা।
প্রতিবারই যখন আমরা তাদের দিকে তাকাই, দেখতে পাই শুধু আগুন বা ধোঁয়া নয় ;
দেখতে পাই– মানুষের দুমড়ে-মুসড়ে যাওয়া জীবনকে নতুন করে গড়ার প্রয়াস।
চিকিৎসা, পুনর্বাসন, আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা, ও সবচেয়ে জরুরী– শান্তিচিন্তা।
এই স্মৃতি আমাদের শেখায়–
প্রগতি যদি মানবিকতার নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত না হয়,
তবে তা সহজেই অন্ধকারের আর্তনাদে পরিণত হবে।

আজকের দায়িত্ব ও সতর্কবার্তা

আজও আশ্চর্যের কিছু নেই, পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর মাটিতে।
কিন্তু হিরোশিমা-নাগাসাকির শিক্ষা বলছেঃ
প্রতিশ্রুতি, সংলাপ, নিয়ন্ত্রণ ও কর্মযজ্ঞই পারে এই হুমকিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে।
আন্তর্জাতিক চুক্তি, নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টা– এসবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অন্য ভরসা।
নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন যে প্রযুক্তির ব্যবহারের নৈতিকতার গুরুত্ব ঠিক কতটা গভীর।
ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে– শক্তি যতই অধিকার করুক,
এর ব্যবহার যদি মানবিক বিচারবোধকে ছাপিয়ে যায়, ফল ভয়াবহ ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছু হবে না।
শেষে হয়তো শুধুই স্মরণ আর বেদনার ইতিহাসে ভর্তি হয়ে যাবে পাতার পর পাতা,
তবু স্মৃতিগুলো যদি আমাদের সতর্ক রাখে,
যদি নতুন প্রজন্মকে শেখায় সহমর্মিতা, সহনশীলতা এবং বিস্ময়ভরা সতর্কতা,
তাহলে হিরোশিমা ও নাগাসাকির ছায়া কেবল অতীতের অন্ধকার নয়,
বরং হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের একটা আলো।
অতীতের ছাই থেকে উঠে আসা সেই আলো যদি আমাদের পথ দেখায়,
মানবতার সহাবস্থানের পথ–
তাহলে হয়তো এই ভয়াল সকালগুলোর স্বর আমরা পুরোপুরি বৃথা বলব না।

নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা

আমাদের দায়িত্ব এখন স্পষ্ট–
একদিকে স্মরন করতে হবে যারা হারিয়ে গেছে, যাদের হাসি আর নেই ;
অন্যদিকে কাজ করতে হবে প্রযুক্তিকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত করতে,
রাজনীতিতে নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে।
কারণ নয়তো, একদিন আবার এমনই কোনো সকাল এসে দাঁড়াবে–
যার আলোতে দাহবে মানবতার শেষ অবশিষ্ট গ্লানি।
আর সেই দিনের ভিতর দিয়ে পার হওয়ার ক্ষমতা আমাদেরই হাতে থাকা উচিৎ।
ঘৃণা নয়, সতর্কতা ; ধ্বংস নয়, সদিচ্ছা।

সাধারণ মানুষের হাতে এ ক্ষমতা বরাবরই থাকে না।
রাষ্ট্র নেতা-মন্ত্রীরা যদি এমন সিদ্ধান্ত নিতে কখনও যান,
এর আগে গণমত ও জনসংলাপ নেওয়া অপরিহার্য হওয়া উচিৎ।
কারণ– তাঁদের ভুলের মাশুল লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষের জীবন,
ভবিষ্যৎ কোনো মূল্যেই, যুক্তিতেই, আইনেই হতে পারে না।
সাধারণ মানুষের জীবন, আশা, নিরাপত্তা কখনও রাজনীতির লোভ,
অহঙ্কার, হঠকারিতা বা অবহেলার শিকার হওয়া উচিৎ নয়।
ইতিহাস যেন মাথায় রেখে তাঁরা রাষ্ট্রের দায়িত্ব সামলান, কারণ সে আজও বলছে–
যে শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তার ফল অবশ্যম্ভাবী প্রলয়, ধ্বংস, বিপর্যয়।
ক্ষমতা ন্য্যায়বিচারের সাথে না মিললে, ভবিষ্যৎ– কালের অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবে।

 

( বিজ্ঞানী, গবেষক থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে,
আজ চাঁদের না দেখা দিক নিয়ে আগ্রহ, মাত্রা ছাড়িয়েছে এর সীমার।
পড়ুন– Click: চাঁদের অদেখা দিক– রহস্য, বিজ্ঞান ও ভুল ধারণার ইতিহাস! )

 

 

 

 

 

 

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

ক্ষোভে-দুঃখে একজন মেয়ে মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঈশ্বরের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ছেন, এবং তাঁর বুকে অভ্যন্তরীণ ন্যায়ের বীজ জ্বলছে। ঈশ্বর আছেন কি নেই—এই নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং মানবতার দায়বদ্ধতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের পরীক্ষা!

ঈশ্বর আছেন, না নেই?– ন্যায়ের খাঁড়ায় বিশ্বাস ও অস্থিরতা মানুষের মন বহুবার একই জায়গায় এসে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *