পেটের ছোট্ট অস্বস্তি থেকে বড় বিপদঃ
পেটের ছোট্ট অস্বস্তি থেকে একেবারে জীবন-মরণ প্রশ্ন।
ঢেকুর বা বুকজ্বালা হিসেবে যেগুলোকে বাইরে থেকে আমরা নিই হালকা ছলে,
আসলে সেগুলোই হতে পারে শরীরের ভিতরে জমে থাকা মৃত্যুর বীজ।
এক চিমটে ঝাল, এক ঢোক কোল্ড ড্রিংকস্ বা এক রাতের অনিদ্রা-
অজান্তেই শরীরের ভিতরে তৈরি করছে অদৃশ্য এক বিস্ফোরণ!
এ অস্বস্তি কেবল পেটের মধ্যে আটকে থাকে, তা কিন্তু নয়।
বরং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শ্বাসে, রক্তে এমনকি মস্তিষ্কে।
গ্যাস সম্পর্কে সাধারণ ভ্রান্ত ধারণাঃ
সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনায় আমরা অনেকেই ভাবি-
“গ্যাস মানে সামান্য অস্বস্তি!”
কিন্তু চিকিৎসা বলছে-
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস থেকে তৈরি হওয়া গ্যাস-অম্বল সরাসরি না হলেও,
এভাবে চলতে থাকলে, এটাই কিন্তু পরোক্ষভাবে একদিন বাড়াতে পারে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতন ঝুঁকি।
এ প্রসঙ্গে জেনে নিই-
হার্ট অ্যাটাক আর স্ট্রোক কি?
হার্ট অ্যাটাকঃ
কোথায় হয়?
হৃদপিণ্ড বা হার্টে।
কারণ?
সাধারণত দায়িত্ব নিয়ে হৃদপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয় করোনারি ধমনি।
এক্ষেত্রে এই ধমনি পাইপের ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে বা চর্বি জমে যায়।
ফল?
রক্ত ও এর হিমোগ্লোবিনের মধ্যে থাকা অক্সিজেন আর পৌঁছতে পারে না হৃদপিণ্ডে।
তখন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় হার্টের পেশি বা মারা যায়।
লক্ষণঃ বুক ধড়ফড়, বুকের মাঝখানে চাপা ব্যথা, হাত, গলা,
বা চোয়ালে ব্যথা ছড়ানো, ঘাম, শ্বাসকষ্ট।
( ভারতীয় ফিল্ড মার্শাল
শ্যাম মানেক’শ একবার করে বসেছিলেন সেই ধরিত্রি কাঁপানো উদ্ধৃতিঃ
“যে ব্যক্তি বলে সে মৃত্যুভয়ে ভীত নয়,
সে হয় মিথ্যেবাদী, নয় এক গোর্খা!”
পড়ুন কার্তুজ সাহাবের সেই রুদ্ধশ্বাস কাহিনীঃ
“৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় আর্মির সেই অপরিশোধ্য অবদান কি মনে আছে বাংলাদেশের?”)
আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবিঃ
পেটের ভিতরে জন্ম নেওয়া এই নীরব শত্রু আসলে আমাদের আধুনিক জীবনের এক প্রতিচ্ছবি।
অস্থিরতা, লোভ আর অবহেলার এক ভয়াল ফসল।
স্ট্রোকঃ
কোথায় হয়?
মস্তিষ্ক বা ব্রেইন-এ।
কারণঃ
- ইস্কেমিক স্ট্রোক : এক্ষেত্রে রক্ত জমাট (Clot) বেঁধে মস্তিষ্কে বন্ধ হয়ে যায় রক্তপ্রবাহ।
- হেমোরেজিক স্ট্রোক : এক্ষেত্রে রক্তনালী ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
ফলঃ
মস্তিষ্কের কোষ অক্সিজেন না পেয়ে মারা যায় দ্রুত।
লক্ষণঃ
হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, শরীরের কোনও এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি।
দাদু-ঠাকুমাদের যুগ বনাম আধুনিক যুগঃ
আমাদের দাদু-ঠাকুমাদের সময়ে খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ, শৃঙ্খলাপূর্ণ।
দুপুরে নিয়মিত ভাত-ডাল, সবজি, প্রয়োজনে মাছ, মাংস, ঘি, দুধ।
পেট ভরলেই যেন তাঁরা তৃপ্তি পেতেন।
জীবন যাত্রায় ছিল স্বাভাবিক ছন্দ।
ঘরোয়া খাবারই তখন ছিল একমাত্র ভরসা বা প্রাধান্যের জায়গা।
এরপর হাঁটাহাঁটি, শারীরিক পরিশ্রম
সন্ধ্যায় হালকা জলখাবার, রাতে তাড়াতাড়ি শোয়া, একপ্রকার স্ট্রেস ফ্রি জীবনযাপন।
আধুনিক জীবনে পরিবর্তনঃ
ব্যস্ততম জীবনে এখন পেট ও মন দুই ভরা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্ট্যাটাস।
কি খাওয়া হল?
যদি কেউ প্রশ্ন করে বসে,
উত্তর দিতে কেমন যেন দ্বিধা হয়,
লজ্জা লজ্জা লাগে-
এই ভাত, ডাল, অমুক শবজি বা
মাছ, মাংস কিছু একটা।
নতুন খাবারের তালিকাঃ
সেখানে যদি উত্তর হয় এটা-
- ব্রেকফাস্টে: ব্রেড-অমলেট, স্যান্ডুইচ কিংবা ইডলি, ডোসা।
- লাঞ্চে: বিরিয়ানি বা চাইনিজ।
- সন্ধ্যায় : মোমো, চাউ, পিৎজা, পেস্ট্রি কিংবা পাস্তা।
- ডিনারে: লাঞ্চের পুনরাবৃত্তি বা কিছু এদিক ওদিক।
সময় যত এগিয়ে গেল-
ধীরে ধীরে বদলে গেল মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস।
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল-
চাইনিজঃ চাউ, চিলি চিকেন, মাঞ্চুরিয়ান।
নেপালিঃ মোমো, থুকপা।
আমেরিকানঃ বার্গার, ফ্রায়েড চিকেন, স্যান্ডউইচ।
ইতালীয়ঃ পিৎজা, পাস্তা।
তুর্কিঃ শাওয়ারমা, কাবাব।
জাপানিঃ সুশি।
থাইঃ থাই নুডলস্, থাই কারি।
লেবানিজঃ হুমাস, পিটা ব্রেড।
মেক্সিকানঃ টাকো, বুরিটো।
ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকল আমাদের খাবারের সংস্কৃতি।
গ্যাসের নীরব বিদ্রোহঃ
আজ অনেক বদলে গেছে আমাদের জীবন।
কাজের চাপ, অ্যাংজাইটি, রাত জাগার প্রবণতা, দৈহিক পরিশ্রম কম, ফাস্ট ফুডে আসক্তি- সব মিলিয়ে আমাদের পেটের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে এক অদৃশ্য শত্রু:
গ্যাস।
পাশাপাশি ফাস্ট ফুডে আসক্তরা ভবিষ্যতে নিজেরাই নিজেদের শরীরে ক্রমশঃ ঢোকাচ্ছে স্থুলতা,
ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টের রোগ ও হজমের সমস্যা।
সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা ভেবে থাকি-
খাবার হজম না হলেই শুধু গ্যাস হয়।
কিন্তু প্রকৃত সত্যিটা হল- এটা আমাদের শরীরের ভিতরের এক নীরব বিদ্রোহ।
শরীরের সতর্ক সংকেতঃ
খাবার যখন প্রাকৃতিক নিয়মে ভাঙতে পারে না, তখন আমাদের অন্ত্রে জমে যায় অযাচিত বাতাস।
আর এই বাতাসই হল আমাদের লোভ (ভাজাভুজি, মশলাদার খাবার), অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া ও অবহেলার (পরিমান মতন জল না পান করা, ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করতে না চাওয়া) ফসল।
এভাবে শরীর যেন বলতে চায়-
“তুমি আমাকে বোঝোনি,
তাই আমি তোমাকে বোঝাতে বাধ্য করছি।”
এক ফোঁটা বাতাস, এক ভয়ঙ্কর প্রভাবঃ
একটু ভেবে দেখুন-
এক ফোঁটা বাতাস যদি ঢোকানো যায় বেলুনে, ধীরে ধীরে তা ফুলতে থাকে।
পেটও ঠিক তেমন, গ্যাস জমে গেলে শুধু পেটে নয়, চাপ তৈরি হয় চারপাশেই।
চাপ পড়ে ডায়াফ্রামে, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
চাপ পড়ে হার্টে, ফলে বুক ধড়ফড় করে।
মস্তিষ্কে বদলে যায় সংকেত, মাথা ঘোরে।
ভাবুন : ছোট্ট এক বুদবুদ বাতাস আমাদের সমগ্র দেহের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়।
( বৃদ্ধ বয়স শুধু বয়স নয়, জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও শেষ অধ্যায়।
এ বয়সে দাড়িয়ে শরীর দুর্বল হয়, মন দুর্বল হয়, স্মৃতি দুর্বল হয় ও দৃষ্টি হয়ে যায় ম্লান!
পড়ুনঃ “জীবনের শেষ দশায় বাবা-মা কি সন্তানের বোঝা, না আশীর্বাদ?”)
চিকিৎসকদের সতর্কবার্তাঃ
চিকিৎসকরা বলেন: অনেক রোগী বুকের ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে যান,
ভেবে নেন, এটা হয়তো গ্যাস।
কিন্তু আসলে তা হার্ট অ্যাটাক।
অন্যদিকে, সত্যিই যদি গ্যাস হয়,
তবুও বুকজ্বালা, চাপা ব্যাথা হতে পারে এতটাই তীব্র, যে বেমালুম গুলিয়ে যায় হার্ট অ্যাটাক- এর সাথে।
ফল- রোগী দেরি করে ফেলেন, খেলা হয়ে যায় জীবনের সাথে।
আসুন ঘটনাটা একবার ভাবা যাক-
গ্যাস জমলে শরীরে কি কি সমস্যা হয়?
( সরাসরি না হলেও উপসর্গের মাধ্যমে )
পেটে চাপঃ
গ্যাস জমলে পেট ফেঁপে ওঠে, – অস্বস্তি তৈরি হয়।
ডায়াফ্রামে চাপঃ
শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুক ভারী লাগে।
হার্টে বিভ্রান্তিঃ
বুকের মাঝখানে ব্যথা বা চাপ সৃষ্টি হয়ে হার্ট অ্যাটাকের মতন মনে হতে পারে।
মস্তিষ্কে প্রভাবঃ
শ্বাসকষ্ট বা অস্বস্তির কারণে মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়াও হতে পারে।
বড় ঝুঁকিঃ
এ উপসর্গগুলো অনেক সময়ে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের প্রকৃত লক্ষণের সাথে মিশে যায়, ফলে রোগী দেরি না করে চিকিৎসা নেয়, আর সেই দেরিই ঘটায় ভয়ঙ্কর পরিণাম।
এ যেন এক ডমিনো ইফেক্ট, একটা ছোট সমস্যা টেনে নিয়ে আসে
ভয়ঙ্কর পরিণতি।
গ্যাসকে উপেক্ষা করার ফলাফলঃ
গ্যাসকে যদি উপেক্ষা করেন বারবার, সে অপমানিত বোধ করে, ফলে সে ধীরে ধীরে শরীরের নানা জায়গায় অস্বস্তি বা সমস্যা ছড়াতে শুরু করে।
হার্টেঃ
বুকের মাঝখানে চাপ বা ধড়ফড় তৈরি হয়, যা অনেক সময়ে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গের সাথে মিশে যেতে পারে।
ফুসফুসেঃ
ডায়াফ্রামে চাপ পড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুক ভারী হয়ে গেছে।
লিভারেঃ
নিয়মিত হজমের সমস্যা থাকলে দীর্ঘমেয়াদে লিভার দুর্বল হয়ে পড়তে পারে বা বেড়ে যেতে পারে ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি।
কিডনিতেঃ
পর্যাপ্ত জল না খেলে বা অনিয়মিত খাদ্যাভাসে কিডনির উপরে চাপ পড়ে, ফলে বাড়তে পারে পাথর বা অন্যান্য জটিলতা।
মস্তিষ্কেঃ
অক্সিজেনের ঘাটতি বা শ্বাসকষ্টের কারণে মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা কিংবা হালকা বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।
সারকথা, আমরা বুঝতেই পারি না- পেটের ভিতরের এক অদৃশ্য চাপ কিভাবে শত্রু হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র শরীরের।
আয়নার সামনে কিছু প্রশ্নঃ
আসুন এবারে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াই।
প্রশ্ন করি নিজেকে,
- আমি কি প্রতিদিন ফাস্ট ফুড খাই?
- আমি কি প্রতিদিন নিয়মিত কোল্ড ড্রিংকস, চিপস,সোডা খাই?
- আমি কি দেরি করে খাই?
- আমি কি কম জল খাই?
- আমি কি কারণে-অকারণে শারীরিক পরিশ্রম করতে চাই না?
- আমি কি ব্যায়াম বিমূখ?
যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, গ্যাস অলরেডি হয়ে গেছে
আপনার নীরব সঙ্গী।
আজ অস্বস্তি, কাল মাথা ঘোরা, একদিন হয়তো…স্ট্রোক!
শরীরের সতর্ক সংকেত উপেক্ষার পরিণতিঃ
দিনের পর দিন শরীরকে এর স্বাভাবিক নিয়মে থাকতে না দিলে, অত্যাচার, অবিচার করলে,
শরীরও ছেড়ে কথা বলবে কেন?
আমাদের দেহ আমাদের শত্রু নয়, মন্দিরের মতন।
এ বারবারই সংকেত দেয়- ঢেকুর,বুকজ্বালা, মাথা ব্যাথা।
এগুলো আসলেই সতর্কবার্তা।
দেহ বলে- “আমাকে অবহেলা করো না- তোমার জীবনের আলো জ্বলে আমার ভিতরেই।”
কিন্তু আমরা তা শুনি না ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত বিপদে না পড়ি।
যেই বিপদ হল, বেড়ে গেল সচেতনতা।
এটা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ক্ষেত্রেও তাই, বিপদ এখনও আসেনি,
তাই সচেতনতাও শূন্য।
গ্যাস থেকে বাঁচার উপায়ঃ
গ্যাস থেকে বাঁচার উপায় কোন ম্যাজিক নয়, বরং সহজ কিছু অভ্যেস।
- সময় মত খাওয়া।
- তেল ঝাল, মশলাদার খাবার ও ফাস্টফুড যথা সম্ভব এড়িয়ে চলা।
- প্রতিদিন পরিমাণ মতন জল পান করা।
- যথাসম্ভব হাঁটা, শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা।
- রাত জাগা এড়িয়ে চলা।
- স্ট্রেস কমানো ইত্যাদি।
এসব হল সেই ছোট্ট ছোট্ট চাবি, যা দেহকে মুক্তি দেয়।
সর্বশেষঃ
এক ফোঁটা গ্যাস, এক ফোঁটা অবহেলা-
এটাই হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ!
আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্যাস মানেই শুধু পেট ফাঁপা নয়।
এর উপসর্গ অনেক সময় মিশে যেতে পারে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের লক্ষণের সাথে, ফলে রোগী বিভ্রান্ত হয়।
আর এই বিভ্রান্তি থেকে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে হতে পারে মারাত্মক বিপদ!
তাই আজ থেকেই শুরু হোক পরিবর্তন।
খাবারের সরলতা, জীবনে নিয়ম, দেহের প্রতি সম্মান-
এই হল গ্যাসের বিরুদ্ধে প্রকৃত অস্ত্র।