প্রকৃতির অবমাননা : মানব সভ্যতার অস্তিত্ব সংকটের পূর্বাভাস!

“মানুষ কি প্রকৃতির প্রভু, না কি অতিথি?

আজকের পৃথিবীতে প্রকৃতির অবমাননা

(Environmental Degradation)

আমাদের অস্তিত্বকেই করছে প্রশ্নবিদ্ধ।”

মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজ
এক বড় ভুল হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণা যে –
মানুষ পৃথিবীর একমাত্র প্রভু, আর এর জীবন্ত প্রমাণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং।

(গ্লোবাল ওয়ার্মিং সতর্কতা নিয়ে লেখাটা পড়তে পারেন)
গ্লোবাল ওয়ার্মিং সতর্কতা: এখনই সময় জেগে ওঠার!🌡️

অথচ সত্যি হল- মানুষ অগণিত জীবের মধ্যে একজন মাত্র অতিথি।

কিন্তু সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে ঘটাতে মানুষের অহংবোধ আজ গিয়ে পৌঁছেছে এমন জায়গায় যে-
যে প্রকৃতির গর্ভ থেকে জন্ম নিল মানুষ,
যে পৃথিবী তাঁদের একমাত্র বাসস্থান,
যে প্রকৃতি দিল মানুষকে এত স্নেহ-ভালোবাসা, আশীর্বাদ,
করলো বিশ্বাস- তাকেই ধ্বংস করার জন্যে যা যা করণীয়?
সেই সব মানুষ করছে প্রত্যেকটা দিন একটু একটু করে।

প্রযুক্তি, শিল্প, নগরায়ণ-
সবকিছুর অন্তরালে এক অদম্য লোভ, সীমা ছাড়িয়েছে সেই কবেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল-
এমন একটা বিকৃত প্রকৃতি নিজেদের হাতে বানিয়ে,
আদৌ কি টিকে থাকতে পারবে মানুষ?
না কি দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও অপমানে শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে প্রকৃতি অ্যাপ্লাই করবেই নিউটনের ‘থার্ড -ল?’

আর ঠিক তখন’ই বোধহয় মানুষের সভ্যতার এই অহংকার মিশে যাবে মাটিতে।
কিন্তু জেগে আর উঠবে না চেতনা,
সুযোগ আর পাবে না আফসোসটুকুও করার-
কারণ থাকবে না সে সময়ে মানুষের অস্তিত্বই।

প্রকৃতির অদৃশ্য স্নেহঃ

প্রকৃতি আমাদের প্রতি কোনও দিন বৈরী তো হয়’ই নি,
বরং প্রকৃতির বুকে হাসিতে-খুশিতে,
আনন্দে, সুখে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের দিয়েছে অক্সিজেন।
দিয়েছে খাদ্য, পানীয় জল, ওষুধ এর মতন গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান।
কিন্তু আমরা প্রকৃতির এই স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-যত্নকে ভেবে নিয়েছি দুর্বলতা।
আমরা ভুলে গেছি-
গাছ কাটা মানেই বাতাসকে কেটে ফেলা।
নদী বা জল দূষিত করার মানেই নিজেদের রক্তকে বিষাক্ত করা।
মাটি শুষে নেওয়ার মানেই নিজেদের পায়ের তলায় শূন্যতা বাড়ানো।

প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক একতরফা নয়;
মানুষ যতটা নেয়, ততটা না হোক, অধিকাংশ ফিরিয়ে দিতে হয় এর বুকে।
কিন্তু নিজেদের স্বার্থ মেটাতে, আজ পর্যন্ত মানুষ শুধুই নিয়েছে- দেয়নি কিছুই ফিরিয়ে।
তবে ভারসাম্য থাকে কিভাবে?

( যে ডাকাতি শুধু সম্পদ নয়,
ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভারতবাসীর মর্যাদাও।
পড়ুন ব্রিটিশদের ভারত শোষণের সেই নির্মম ইতিহাস।)

“কোহিনূর থেকে ধানক্ষেত, ঔপনিবেশিক ডাকাতদের সেই প্রায় ১৯০ বছর!”

শিল্পায়নের মুখোশে লোভঃ

মুনাফার জন্যে প্রকৃতির বলিঃ

আজকের পৃথিবীতে শিল্পপতিরা প্রকৃতিকে অবমাননার প্রধান কারিগর,
অথচ এরাই দাবী করে নিজেদের “পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব” হিসেবে।
শিল্পপতিরা বন মানে দেখতে পায় জমি।
নদী মানে দেখতে পায় ড্রেনেজ সিস্টেম।
আর বাতাস মানে কারখানার ধোঁয়া জমা রাখার ভাণ্ডার।

এদিকে কারখানার ধোঁয়া ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে আকাশের স্বচ্ছতা।
রাসয়নিক বর্জ্য নদী, জলাশয়ে ফেলে জলকে পরিণত করছে বিষে।

অতি-উৎপাদন আর প্লাস্টিকের আগ্রাসনে দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রকৃতির।
বন উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল-
কি, না সভ্যতা উন্নতি করছে।

তাঁদের কাছে প্রকৃতি কোনও মা, ফা নয়, বরং শোষণের এক খনি-
যত করা যায় খনন, মুনাফা তত বেশি।
মুনাফার নেশায় বুঁদ হয়ে তাঁরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে,
যে মাটি থেকে গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়, সেই মাটিই যদি একদিন উর্বরতা হারায়-
তবে সেই টাকার পাহাড় কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই মাটি?
পারবে কি বাঁচতে?

সভ্যতার আত্মবিস্মৃতির ট্র‍্যাজেডিঃ

মানুষ এখন উন্নয়ন মাপে অট্টালিকার উচ্চতায়-
ভুলে যায়, সেই অট্টালিকার ভিতরে
নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাস আসে কোথা থেকে?

বন উজাড়ে বাড়ছে ঝড়-বন্যা।
দূষণে বাড়ছে রোগ-ব্যধি, মুনাফা লুঠছে ওষুধ শিল্প।
জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদন ক্রমশঃ যাচ্ছে কমে, বাড়ছে দ্রব্যমূল্য।

এ যেন এক মহা-বৈপরীত্য-
মানুষ যত উন্নত হচ্ছে, ততই এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের মুখে।

প্রকৃতির প্রতিশোধ: নীরব কিন্তু অনিবার্যঃ

প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় না ক্রোধে, নেয় ভারসাম্যে।
ধীরে ধীরে দানব আকৃতি নিচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা-
ফল, কংক্রিটের শহরের অস্তিত্ব সারাজীবনের মতন শেষ!
ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছে পানযোগ্য জলের উৎস-
ফল, কোটি কোটি মানুষ এক ফোঁটা জলের জন্যে ছটফট করবে।
তাপমাত্রা বাড়ছে-
ফল, সোনার ফসল রূপান্তরিত হবে আগুনে, হবে নষ্ট।

সৃষ্টি হবে নিত্যনতুন আরও রোগ, ভেঙে পড়বে সভ্যতার অহঙ্কার।

প্রকৃতির প্রতিশোধ আসলে ন্যায়ের প্রয়োগ-
মানুষের অবহেলা, উদাসীনতার বিপরীতে এ প্রকৃতির এক অন্য হিসেব।

দার্শনিক পাঠঃ প্রকৃতিকে ধ্বংস মানেই আত্মহত্যা।

যে মানুষ ভাবছে প্রকৃতিকে জয় করে ফেলেছে-
সে আসলে খুঁড়ছে নিজের কবর।
কারণ- প্রকৃতি আমাদের বাইরে নয়,
ভিতরে।
গাছের নিঃশ্বাসেই আমরা শ্বাস নিই।
বেঁচে থাকি নদীর জলেই, যেভাবে বাঁচতাম সিন্ধুতে।
মাটি দান দেয় বলেই আমরা জীবন চালাতে পারি।

তাহলে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানেই, ধ্বংস করা নিজেকে।
এটা কোনও বাইরের বিপদ নয়, বরং আত্মহত্যার আরেক নাম।

করণীয়ঃ

অতিরিক্ত মুনাফার নেশা থেকে মুক্তি ।

ব্যক্তি ও সমাজের দায়িত্বঃ

  • পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন বেছে নেওয়া।
  • বিদ্যুৎ, জল ও খাদ্যের অপচয় যথাসম্ভব কমানো।
  • যথাযথ গাছ লাগানো ও প্রকৃতিকে যত্ন নেওয়া।

রাষ্ট্র ও শিল্পের দায়িত্বঃ

  • কারখানার বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে কঠোর আইন চালু করা।
  • পরিষ্কার জ্বালানির ব্যবহার করা।
  • প্লাস্টিক উৎপাদন সীমিতকরণ করা।
  • শিল্পপতিদের মুনাফার সীমারেখা টেনে দেওয়া উচিৎ।
  • উন্নয়ন আর প্রকৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করাই একমাত্র সমাধান।

প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান’ই ভবিষ্যৎঃ

মানুষ যদি প্রকৃতিকে কেবল শোষণের খনি ভাবে, তবে নিজেদের ধ্বংস নিশ্চিত।
আর যদি মানুষ এখনও বোঝে- প্রকৃতি’ই তাঁদের জীবন,
তবে সম্ভব সেই সভ্যতার জন্ম দেওয়া- যা ছিল আগে,
আগে ও এখন- ভারসাম্য রেখেই।

আজকের মূল প্রশ্ন হল-
আমরা কি প্রকৃতির অবমাননা করে, শত্রু হয়ে বিলীন বা নিশ্চিহ্ন হব?
না বন্ধু হয়ে থাকবো মিলেমিশে, হাসিতে, খুশিতে, আনন্দে?

উত্তর কিন্তু আমাদের হাতেই-
আর সিদ্ধান্তে দেরি করার সময়ও নেই।

 

তন্ময় সিংহ রায়

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলঃ মায়ামি, হ্যামিলটন, সান হুয়ানের ত্রিভুজ। গভীর সমুদ্রে রহস্যময় স্টার গেট, জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল– সমুদ্রের অদৃশ্য রহস্য ত্রিভুজ!

রহস্যের সামনে নির্বাক সভ্যতাঃ পৃথিবী– এর গর্ভে আজও যে কত বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *