জীবনের শেষ দশায় বাবা-মা কি সন্তানের বোঝা, না আশীর্বাদ?

“নয় শুধু ডিগ্রী ও প্রাচুর্য দীক্ষায়-

সন্তান হোক বড় মানসিক শিক্ষায়।”

শৈশব, কৈশোর, প্রৌঢ়, বার্ধক্য-

মানব জীবনের চার দশাঃ

বৃদ্ধ বয়স শুধু বয়স নয়, জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও শেষ অধ্যায়।
এ বয়সে দাড়িয়ে শরীর দুর্বল হয়, মন দুর্বল হয়, স্মৃতি দুর্বল হয় ও দৃষ্টি হয়ে যায় ম্লান!
এই বয়েসেই মা-বাবা সবচেয়ে বেশি স্নেহ, নিরাপত্তা ও যত্ন-ভালোবাসার আশায় বুক বেঁধে থাকেন।

সন্তানের পাশে থাকার আকাঙ্ক্ষাঃ

জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে যাদের আঙুল ধরে সন্তান হেঁটেছে,
সেই বাবা-মা শেষ বয়সে চান বিশেষত একটাই জিনিস- সন্তানের পাশে থাকা।

কিন্তু আজকের সমাজে এমন কত সন্তান আছে,
যারা ব্যস্ততার অজুহাত কিংবা স্বার্থের খাতিরে ভুলে যায়, অবহেলা করে,
এমনকি দেখতে পর্যন্ত যায় না সেই বাবা-মাকে, যাঁদের জন্যে সে আজ এই জায়গায়।

স্ত্রী এর প্রভাব ও মানসিকতার বৈপরীত্যঃ

বহু ক্ষেত্রে স্ত্রী দ্বারা প্ররোচিত হয়েও অনেক সন্তান ঘটায় এমন ঘটনা-
সে স্ত্রী এর ভয়েই হোক, প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, অশান্তি এড়াতেই হোক,
বা হোক নিজের মানসিক বিকৃতির কারণে।
মনে রাখা উচিত-
স্ত্রী এর বাবা-মা তাঁরা নন, শুধু স্বামীর বন্ধনের শর্তে, সম্মানার্থে তাঁরা বাবা-মা।
আবার বহু স্ত্রী আছে এর ঠিক উল্টোটা, তাঁদের কাছে চার বাবা-মাই একেবারে সমান।

অদ্ভুৎ ( Strange ) মানসিক বিবর্তনঃ

কি এক অদ্ভুৎ মানসিক বিবর্তন-
জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ না হওয়া অবস্থাতে, বাবা-মা’ই পৃথিবীর মতন।
আর যেই হয়ে গেল জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ, সন্তান যেন হয়ে গেল জ্ঞান-বুদ্ধিহীন, নির্বোধ।

( এক চিমটে ঝাল, এক ঢোক কোল্ড ড্রিংকস্‌ বা এক রাতের অনিদ্রা-
অজান্তেই শরীরের ভিতরে তৈরি করছে অদৃশ্য এক বিস্ফোরণ! 

পড়ুনঃ “বর্তমান খাদ্যাভাসে লুকানো কুখ্যাত মাফিয়া-গ্যাস!” )

কেন সন্তানরা ভুলে যায় বাবা-মাকে?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে- মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান আর বাস্তবতার জটিল পথ ধরে হাঁটতে হয়।

১. অতিরিক্ত ব্যস্ততাঃ

আধুনিক জীবনের প্রতিযোগিতা, ক্যারিয়ার বা অর্থ উপার্জনের ইঁদুর দৌড়,
মানুষকে ধীরে ধীরে বানিয়ে ফেলেছে সময়ের দাস।
সন্তান ভাবে- সময় নেই, অথচ জীবনের ঠিক এই সময়টাই বাবা-মায়ের,
একজন সন্তানকে যথাসম্ভব প্রয়োজন।
এরকমই কত ‘ঘন্টা’ বাবা-মা, কম-বেশি একসময় তার সন্তানের জন্যে উজাড় করে দিয়েছিল
নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে, হাসতে হাসতে।

২. স্বার্থকেন্দ্রিকতাঃ

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে-
যে সম্পর্ক থেকে আর কোনো উপকার পাওয়া যায় না, তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
অনেক সন্তান মনে করে-
বৃদ্ধ বাবা-মা এখন তাঁদের জীবনে ‘বোঝা’ বা ‘মাথাব্যথা’ এর মতন,
তাই তাঁদের এড়িয়ে, পরিবর্তে নিজের কাজ বা ক্যারিয়ারে ফোকাস করা,
অনেক বেশি বুদ্ধিমানের মতন কাজ হবে, বা হবে লাভজনক।
আর এ সময়ে দাঁড়িয়ে এড়িয়ে চলাটাও হয় বেশ সহজ একটা কাজ।

৩. সংবেদনশীলতার অভাবঃ

একসময় যে সন্তান কেঁদে, নিশ্চিন্তে একদিন ঘুমাতো মায়ের কোলে।
যে মা তার সন্তানের জন্যে-
প্রতিদিন একটু একটু করে মাটিতে পুঁতেছে নিজের সাধ, আশা, স্বপ্নগুলোকে।
সেই সন্তান বড় হয়ে বেমালুম ভুলে গেল মায়ের সেই মমতাকে, আত্মত্যাগকে।
সেই সন্তান বড় হয়ে আবেগকে মনে করতে থাকলো দুর্বলতা,
ফলে ভালোবাসার বদলে দেওয়াল গড়ে উঠল দায়িত্বহীনতার।

৪. বাবা-মা এর নীরব আকুতিঃ

একজন বৃদ্ধা মা সারাদিন জানালার পাশে বসে থাকে অধীর আগ্রহে-
‘আজ হয়তো ছেলে আসবে দেখতে, দুটো কথা বলবে,
জিজ্ঞাসা করবে- ‘কেমন আছো মা?’

একজন বাবা প্রতিদিন তার ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে চাতক পাখির মতন-
‘এই বুঝি জ্বলে উঠল মোবাইল স্ক্রিনটা, ভেসে উঠল মেয়ের নাম্বার!’

কিন্তু কোথায়?
দিন যায়, মাস যায়।
অনেক সময়ে কেটে যায় বছরও, তবুও অবসান আর ঘটে না সে অপেক্ষার।
আর এই অপেক্ষাই বাবা-মায়ের জীবনে সবচেয়ে তীব্র এক যন্ত্রণা!
শরীরের ব্যাথা, ক্ষত একসময় কমে আসে, কিন্তু সন্তানের অবহেলার ব্যাথা
কমে তো না-ই, বরং ধীরে ধীরে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় মানুষগুলোকে, অন্তরে জমতে থাকে বরফ।

৫. মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতঃ

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন-
বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা দেখা দেয়, তা হল একাকিত্ব,
এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার বোধ।

যখন সন্তান কাছে থাকে না-
বাবা-মা ভাবেন, ‘আমার হয়তো আর কোনও প্রয়োজন নেই।’
এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় বিষন্নতা, আত্মবিশ্বাস হারানো,
এমনকি মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষাও।
অথচ সত্যি হল-
একজন বৃদ্ধ মানুষ সবচেয়ে বেশি চায় শুধু সঙ্গ, একটু কথা আর যত্ন-ভালোবাসার স্পর্শ।

সন্তানদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাঃ

তুমি আজ যতই ব্যস্ত থাকো,
মনে রেখো-
এমন হাজার ব্যস্ততাকে বাবা-মা একসময় বেমালুম উপেক্ষা করেছে তোমার জন্যে।
বাবা-মা নিজেদের স্বপ্ন ভেঙে ভেঙে গড়েছিল তোমার ভবিষ্যৎ।

তোমার প্রথম হাঁটা, প্রথম কথা বলা, প্রথম স্কুল, প্রথম আবদার-
সব কিছুই কিন্তু তাঁরা গেঁথে রেখেছে বুকের গভীরে।

এই ত্যাগ কি ছিল, তাঁদের প্রতি এই দিন দেখার জন্যেই?
কর্মফল ভোগ করতে হবে সবাইকে, আর তা এ জীবনেই।
এর প্রমাণও বাস্তবে আছে ভুরি ভুরি, শুধু খুঁজে নিতে হবে।

আজ তুমি তোমার বাবা-মা এর পাশে নেই, কাল তোমার সন্তানও হয়তো পাবে এই একই শিক্ষা।
‘বৃদ্ধ হলে, বাবা-মাকে ফেলে দেওয়াই যায়।’
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিন্তু ঘটে এ পৃথিবীতেই, মঙ্গল গ্রহে নয়।

( চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ৯ দিনের সেই স্মরণীয় যুদ্ধঃ
পড়ুনঃ “৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় আর্মির সেই অপরিশোধ্য অবদান কি মনে আছে বাংলাদেশের?” )

সমাজ ও ভবিষ্যতের প্রভাবঃ

যখন সন্তান তাঁর বাবা-মাকে অবহেলা করে, তখন শুধু একটা পরিবার নয়-
আক্রান্ত হয় গোটা সমাজ।
মূল্যবোধ নষ্ট হয়, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জায়গা দখল করে স্বার্থ ও অর্থ।

পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা পায়-
বৃদ্ধদের অবহেলা করা, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়।
হারিয়ে যায় মানবিকতা, সমাজ হয়ে পড়ে যান্ত্রিক, যেখানে সম্পর্ক হয়ে ওঠে কেবল সুবিধার বিনিময়।

সমাধানের পথঃ

১. মানসিক সচেতনতাঃ

সন্তানদের বোঝাতে হবে-
বার্ধক্য কোনো বোঝা নয়, বরং সেটাই জীবনের পরীক্ষার শেষ ধাপ,
যেখানে সুযোগ আসে আসল দায়িত্ব পালনের।

২. পারিবারিক বন্ধন যথাসম্ভব জোরদারঃ

ব্যস্ততা, অজুহাত-
এসবের মাঝেও যথাসম্ভব অন্তত কয়েক মিনিট সময় রাখতে হবে বাবা-মায়ের জন্যে।

৩. সামাজিক উদ্যোগঃ

বৃদ্ধাশ্রম নয়-
বরং পরিবারকেন্দ্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন,
যাতে বিশেষত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাবা-মাকে মনে করে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

শেষ কথা- এমন না হয়ঃ

আজ যারা বাবা-মাকে অবহেলা করছো, করছো উপেক্ষা-
মনে রেখো, সময় অনেককেই বুঝিয়েছে অনেক কিছু, আর ভবিষ্যতেও বোঝাবে।
সময় সবার ক্ষেত্রেই চলে সমান নিয়মে।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হতে হবে সবাইকেই।
বাবা-মা, সন্তানকে অভিশাপ দেন না- প্রকৃতির আইনে, সে অভিশাপ ফিরে আসে বুমেরাং হয়ে।

শেষ দিনগুলোতে বাবা-মাকে সঙ্গ দাও, ভালোবাসা দাও, শ্রদ্ধা বাড়াও, যত্ন বাড়াও,
রাখো হাসিতে-খুশিতে।
মা-বাবা আশীর্বাদ- বোঝা নয়।
একজন ম্যাচিওর অনাথকে প্রশ্ন করো- কেমন লাগে তার বাবা-মা শূন্য জীবনকে?

এমন না হয়-
একদিন সেই সঙ্গের অভাবই তোমার জীবনে নিয়ে এল একবুক শূন্যতা!!

সময় করে একদিন সময় দিয়ে এসো বৃদ্ধাশ্রমে,
কথা বলে অনুভব কোরো সেই সব বাবা-মা এর মর্মান্তিক কাহিনী।

এর পরেও যদি পরিবর্তন না আসে নিজের ভিতরে-
ভেবো, দেহটা শুধু তোমার জীবিত আছে নিজের স্বার্থে, মনুষ্যত্ব গেছে মরে।
এভাবেই সমাজ একদিন হারাবে মনুষ্যত্বহীন আর মনুষ্যত্ববানের ভারসাম্য,
আর সে সমাজে তখন তুমিও বৃদ্ধ, কিংবা বৃদ্ধা।

 

তন্ময় সিংহ রায়

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলঃ মায়ামি, হ্যামিলটন, সান হুয়ানের ত্রিভুজ। গভীর সমুদ্রে রহস্যময় স্টার গেট, জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল– সমুদ্রের অদৃশ্য রহস্য ত্রিভুজ!

রহস্যের সামনে নির্বাক সভ্যতাঃ পৃথিবী– এর গর্ভে আজও যে কত বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *