প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞদের
প্রেক্ষাপটঃ
পাণিনি থেকে আর্যভট্ট-
রামানুজান থেকে উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁর সু-উজ্জ্বল নক্ষত্র সত্যেন্দ্রনাথ বসু
প্রভৃতি, ভুবনজয়ী ভারতীয় গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের নাম ও কর্মদক্ষতার ইতিহাস
আমাদের শ্রুতি ও দৃষ্টিগোচর হয়েছে প্রায় অনেকেরই।
কিন্তু বর্তমানের ১৪৬ কোটি ( ২০২৫-এর সেপ্টেম্বর অনুযায়ী ) ভারতীয়ের সিংহভাগের কাছে
‘বশিষ্ঠ নারায়ণ সিং’– শুধুমাত্র এই নামটার সাথেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিচিতি
আজও তেমন কারো নেই বলাটাই যুক্তিসংগত।
আর তাঁর চিরস্মরণীয় অমূল্য ও মৃত্যুহীন অবদানের মর্মান্তিক ইতিহাস তো দেওয়া যাক ছেড়েই।
জন্ম ও শৈশবঃ
জন্ম ২ এপ্রিল ১৯৪৬ (মতান্তরে ১৯৪২) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিহারে।
ঠিকানা নির্ভুল নির্দেশিত হলে দাঁড়ায়, বিহারের ভোজপুর জেলার বসন্তপুর গ্রামে।
পিতা লালবাহাদুর সিং ছিলেন বিহার পুলিশের কনস্টেবল ও মাতা লাহাসু দেবী, একজন গৃহকর্ত্রী।
ছোটবেলা থেকেই বশিষ্ঠ নারায়ণ বেড়ে ওঠেন চরম দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে।
বশিষ্ঠ যে কোনো সাধারণ বালক নয়, তা ছেলেবেলা থেকেই টের পেয়েছিলেন তো অনেকেই,
বরং ধীরে ধীরে প্রচুর মানুষের মনের জরায়ুতে জন্ম নিতে শুরু করে যে-
তিনি ছিলেন এক পরম বিষ্ময়কর বালক।
হয়তো ঐশ্বরিক কোনো ক্ষমতার অধিকারী।
প্রাথমিক প্রতিভাঃ
ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন তিনি অনায়াসে সমাধান করতেন,
বারো ক্লাসের জটিল থেকে জটিলতর ম্যাথ।
অনুরূপ,
ক্লাস টুয়েলভ-এ পড়তে পড়তে তিনি নিমেষেই সমাধান করতেন,
গ্র্যাজুয়েশনের কঠিন অঙ্কের হিসেব-নিকেশ।
শুধু তাই নয়, গণিতের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও তাঁর দক্ষতা ছিল দর্শনীয়।
অভিনয়তেও তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বশিষ্ঠ নারায়ণের গণিতের এহেন দুর্গম পথে
হাঁটার স্বপ্ন ভুমিষ্ঠ হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই।
গণিতের প্রতি অব্যক্ত ও অকল্পনীয় ভালোবাসাই তাঁর আ-মৃত্যু,
যে একমাত্র সঙ্গী হবে, এটাও তিনি ভেবে নিয়েছিলেন অনেক আগে থেকেই।
শিক্ষাজীবনঃ
১৯৬১ সালে ১৯ বছর বয়েসে-
রেপুটেড ‘পাটনা সায়েন্স কলেজ’-এ ভর্তী হয়ে পড়া-লেখা চলাকালীন,
তিনি প্রফেসরকেই কখনও বলে বসতেন, ‘স্যর ম্যাথ-টা আপনি এভাবে করালে কেমন হয়?’
কখনও আবার বলতেন, ‘স্যর, আপনার শেখানোর পদ্ধতিটা একটু পরিবর্তন করলে ভালো হত।’
এইটুকু ছেলের বাড়-বাড়ন্ত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রাগান্বিত ও অপমানিত কোনো এক প্রফেসর,
তাঁকে একদিন সোজা নিয়ে চলে গেলেন স্বয়ং প্রিন্সিপ্যাল-এর ঘরে।
বশিষ্ঠের গণিত প্রতিভা সম্বন্ধে পূর্বপরিচিত প্রিন্সিপ্যাল তাঁকে বলে বসেন-
‘তুমি গণিতে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছো শুনেছি, ভালো।
তুমি সমাধান করে দাও তো হে আমার এই গাণিতিক সমস্যাটার।’
যথাসম্ভব জটিল সমস্যা এই যুবক ছাত্রের ঘাড়ে চাপিয়ে,
তিনি অপমানের প্রতিশোধের মাধ্যমে উচিৎ শিক্ষা দিতে চাইলে।
কিন্তু সেই স্থানে দাঁড়িয়ে, সেই গাণিতিক সমস্যার, ৪ থেকে ৫ রকম পদ্ধতিতে সমাধান করে,
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত প্রফেসরসহ, বিজ্ঞানী, এমনকি প্রিন্সিপ্যালকেও বিস্ময়ে হতবাক করে দিলেন বশিষ্ঠ।
ফলে ধীরে ধীরে তাঁর তেজোদীপ্ত আলোকছটা’র এই বর্ণনা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো সমগ্র বিহার জুড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও সাফল্যঃ
বি.এস.সি ফার্স্ট ইয়ার-এর ফাইনাল পরীক্ষায় তাঁকে বসতে দেওয়া হল,
বি.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম-এ।
সেখানেও তিনি নম্বর তুললেন রেকর্ড পরিমাণ!
সেকেন্ড স্কোরার-এর চেয়ে অনেকটাই বেশি।
বিস্ময়ের সীমার গন্ডি এখানেই থাকেনি স্তব্ধ হয়ে।
এম.এস.সি’র ক্ষেত্রেও ঘটে গেছিল এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
সেখানেও খুব সহজেই তিনি দখল করলেন সর্বোচ্চ নম্বরের জায়গাটাকে।
মাত্র ২১ বছর বয়েসে তিনি অর্জন করেন এম.এস.সি ডিগ্রী।
সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় এখানেই যে-
এক-একটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান,
তিনি খুব সাধারণভাবেই করে ফেলতেন ৪ থেকে ৫ রকমভাবে।
ফলে এ ক্ষেত্রেও আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ সমস্ত ঘটনার সংবাদ,
ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো সারা হিন্দুস্তান ব্যাপী।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিঃ
৬০ এর দশকে ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া‘-এর একজন স্বনামধন্য ম্যাথমেটিশিয়ান,
প্রফেসর জন.এল.কেল্লি ভারতে কোন এক গবেষণার কাজে এসে,
জানতে পেরে যান বশিষ্ঠ নারায়ণের ম্যাথমেটিক্সের গহীন জ্ঞানের এই সংবাদ।
তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন নিজে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার একান্ত উদ্দ্যেশ্যে।
অতঃপর যাত্রায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে, কেল্লি সোজা চলে আসেন বিহারে।
পরিচয় সম্পন্ন করার পর, তাঁর কথা অনেক শুনেছেন ভারতে আসার পর জানিয়ে,
কেল্লি তাঁকে (বশিষ্ঠ নারায়ণ) ম্যাথমেটিক্সের কিছু অত্যন্ত জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে সমাধান করতে বললে,
তিনি সেখানেও পরিচয় দেন সমদক্ষতার।
মাত্রাতিরিক্ত স্তম্ভিত হয়ে যান কেল্লির মতন খ্যাতিমান গণিতবিদও।
কেল্লি উপলব্ধি করেন-
ইনি কোনো সাধারণ ছেলে তো নন, বরং ভবিষ্যতের গগনচুম্বী এক ম্যাথমেটিশিয়ান।
প্রচুর সুযোগ-সুবিধা ও যশ খ্যাতি সহযোগে,
অনেক উচ্চ ভবিষ্যত তাঁর জন্যে অপেক্ষারত জানিয়ে,
কাল বিলম্ব না করেই তিনি (কেল্লি) প্রস্তাব দিয়ে বসেন তাঁর সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার।
এত বড় এক সুযোগ স্বয়ং তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে স-সম্মানে জানাচ্ছে স্বাগত, ভাবতেই-
দেরী না করে তিনি কেল্লিকে সম্মতি জানালেন ইতিবাচক।
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-তে পদার্পণ করার ৪ বছর পর,
১৯৬৯ সালে ‘সাইক্লিক ভেক্টর স্পেস থিওরি’-তে তিনি অর্জন করেন পি.এইচ.ডি ডিগ্রী।
‘ওয়াসিংটন ইউনিভার্সিটি’তেও বেশ কিছুদিন তিনি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসাবে ছিলেন কর্মরত।
এমনকি, এহেন দক্ষতার গতি সোজা তাঁকে পৌঁছে দেয়-
‘ন্যাশনাল অ্যারোনেটিকস্ অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন'( নাসা )-এর মতন জায়গায়,
সেখানে তিনি আবির্ভূত হন বিজ্ঞানীরূপে।
প্রতিভার বিস্ফোরণঃ
নাসার অ্যাপোলো-১১ মিশনের লুনার মডিউল (চাঁদের মাটিতে মানুষের প্রথম অবতরণ)-
চাঁদের মাটিতে যখন অবতরণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ১২০২ এবং ১২০১ অ্যালার্ম বেজে ওঠে,
কারণ লুনার মডিউল অনবোর্ড কম্পিউটার এর অতিরিক্ত কাজ ( Overload).
লুনার মডিউলের রেডার সিস্টেম ভুলবশতঃ চালু হয়ে যাওয়ায় কম্পিউটারকে একইসাথে কাজ করতে হচ্ছিল একাধিক,
যা এর ধারণ ক্ষমতার বাইরে ছিল।
পাশাপাশি-
৩০-৩১ টা কম্পিউটার ডিভাইস হঠাৎ, ম্যালওয়্যার আক্রান্ত হয়ে ৩০-৩৫ সেকেন্ড-এর জন্যে বন্ধ হয়ে যায়,
যে যার যথাসম্ভব দক্ষতা অনুযায়ী কম্পিউটারগুলো রি-স্টার্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা করে,
কিন্তু ফল শূন্য অবস্থায় সবাই হয়ে পড়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ও হতাশ!
এমন পরিস্থিতিতে সে স্থানে কর্মরত বিজ্ঞানী,
ডক্টর বশিষ্ঠ নারায়ণ সিং তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি করে ফেলেন ক্যালকুলেশনস্।
পরবর্তীকালে কম্পিউটারগুলোর পুনর্জন্মের পর আবিষ্কৃত হয় যে-
তাঁর ও কম্পিউটারের ক্যালকুলেশনস্ ছিল ১০০% অ্যাকিউরেট।
এ অকল্পনীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী-
নাসার তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মনে সৃষ্টি হয় উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের।
ফাঁক হয়ে যায় পায়ের তলার মাটি, এমনকি প্রায় সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াও ছিল কিছুটা এমনই।
সু-বৃহৎ ও দুর্বোধ্য ক্যালকুলেশনস্- তাও আবার সমাধানের গতিবেগ এত দ্রুত?
‘হাউ ইস দিস পসিবল ফর আ হিউম্যান বিয়িং??’
এ হেন যুগান্তকারী ঘটনার পর,
আমেরিকা সরকার তাঁকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং চাকরীতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানালে,
তা উপেক্ষা করে নিজের দেশের জন্যে কিছু করার উদ্দ্যেশ্যে ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণ ফিরে আসেন নিজ রাষ্ট্রে।
এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি- কোনো ঘটনা যদি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না থাকে বা প্রমাণ না থাকে,
তাহলে সময়ের সাথে সাথে এর সত্যতা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক নথিতে উল্লেখ না থাকলে, সেই ঘটনাকে সাধারণত ‘অপ্রমাণিত’
বলে ধরে নেওয়া হয়।
এখন ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণের ক্ষেত্রে কোনও প্রমাণ রাখা হয়নি,
না এ ঘটনা নিছক একটা লোককথা, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
দেশে প্রত্যাবর্তন ও কর্মজীবনঃ
১৯৭২-এ নিজের দেশে ফিরে,
কানপুর আই.আই.টি ( ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ),
টি.আই.এফ.আর ( টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ ) ও
আই.এস.আই ( ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট )-তে তিনি পুনরায় শুরু করেন তাঁর কর্মজীবন।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধঃ
পিতার নির্দেশকে সম্মানবশতঃ ১৯৭৩ সালে,
তিনি অনিচ্ছাকৃত আবদ্ধ হন বন্দনা রানী সিং-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে।
কিন্তু সংসার ধর্মে চরম অনাসক্ত ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণ,
সে মুহুর্তেই দীর্ঘ সময় ধরে ডুবে ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ থিসিস-এর মধ্যে,
যা ছিল শেষের পথে।
মানসিক ভারসাম্যহীনতা , সিজোফ্রেনিয়াঃ
ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের মতানুযায়ী-
বিবাহের কিছুদিন পর থেকেই, ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণের মানসিক অবস্থা রহস্যময়ভাবে শুরু করে খারাপ হতে।
এমত অবস্থায়, অবশেষে তাঁর যে মানসিক অসুস্থতার রোগটা চিহ্নিত করা হয়,
সেটাকে বলা হয় সিজোফ্রেনিয়া।
ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণের অন্তিম পর্যায়ের,
এমন ভয়াবহ মানসিক প্রতিবন্ধকতার বিভিন্ন কারণ হিসেবে অনেকে উল্লেখ করে থাকেন যে-
ওনার রিসার্চ পেপারের অপব্যবহার করেছিলেন কিছু মানুষ,
ফলে তিনি হারিয়েছিলেন মানসিক ভারসাম্য!
কারো কারো মতে-
বছরের পর বছর দিবারাত্র ম্যাথমেটিক্যাল প্রেসারের ফলেই,
ওনার সৃষ্টি হয়েছিল এই মর্মান্তিক পরিণতি।
আবার বসন্তপুর গ্রামের অধিকাংশের মতে-
যেহেতু বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে,
এবং থিসিসে ব্যস্ত থাকার দরুন তিনি সময় দিতে পারবেন না তাঁর স্ত্রীকে,
এও জানিয়েছিলেন পূর্বেই।
স্নান, খাওয়া, ঘুম প্রায় বাদ দিয়েই রাত-দিন কিছু কাগজ নিয়ে-
মাথা, মুখ গুঁজে পড়ে থেকে মিনিমাম সময় না দেওয়া ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণের এ হেন সংসার করার পদ্ধতিতে,
চরম রাগান্বিত ও দুঃখিত, লেখাপড়া বিশেষ না জানা একমাত্র সহধর্মিনী বন্দনা রানী,
আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সমস্ত থিসিস পেপার।
দিবা-রাত্রির ক্লান্তিহীন, অমানবিক পরিশ্রমের ফলস্বরূপ-
প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে আসা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই থিসিস পেপারের মর্মান্তিক মৃত্যুতে,
ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণ প্রায় হয়ে পড়েছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ,
অর্থাৎ- সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, থিসিস পেপারের অন্তিম পরিণতি,
কিছু মানুষ দ্বারা তাঁর থিসিস পেপারের অপব্যবহার, প্রতারণা ও ডিভোর্স,
তাঁর মানসিক অসুস্থতাকে নিয়ে গেছিল একেবারে চরম পর্যায়ে।
ফল- সহ্যের সীমা চুড়ান্ত অতিক্রান্তের ফলে সিজোফ্রেনিয়া।
১৯৭৬-এ দুর্ভাগ্যজনকভাগে স্ত্রীর সাথে ঘটে যায় বিবাহবিচ্ছেদ।
( সারা মন জুড়ে একমাত্র দুর্গা মায়ের গহীন স্মরণে,
শরতের শিশির বিন্দুর মতন তাঁর চিবুক বেয়ে নেমে এল পবিত্র জলের ধারা!
পড়ুনঃ ১৯৩১ সালের মহালয়ার ভোর ৪ টে- ঘটে গেল সেই যুগান্তকারী ঘটনা! )
চিকিৎসা ও প্রতিভার কাছে হার না মানা,
মানসিক অসুস্থতাঃ
এরপর সূত্রপাত মানসিক চিকিৎসার-
ব্যাঙ্গালোরের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ্ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস’
ও দিল্লীর ‘ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান বিহেভিয়ার এন্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস’-এ
চিকিৎসারত ছিলেন তিনি দীর্ঘ ১১ বছর।
শোনা যায়-
মেন্টাল হস্পিটালে ট্রিটমেন্ট চলাকালীন,
তিনি সেখানের কর্মে নিযুক্ত মানুষজনদের ডেকে অনুরোধ করতেন শুধু একটা চক তাঁকে দেওয়ার জন্যে।
আর বদ্ধ ও নিস্তব্ধ কুঠুরির চারদিকের দেওয়াল ও মেঝে জুড়ে ছিল শুধু ম্যাথের ইকুয়েশনস,
ফর্মূলা আর বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা।
যেগুলো দিবারাত্র তিনি সমাধান করতেন, মুছতেন আবার লিখতেন, সমাধান করতেন।
গভীর ভাবনায় অসুস্থ হয়ে পড়ে ভাবনাও যে-
একজন সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মহান গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী মানুষ মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ অবস্থাতেও,
নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থের একান্ত উদ্দ্যেশ্যে,
দেশ-বিদেশ থেকে সেই অবস্থায় আসা নানান বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের বিভিন্ন জটিল গাণিতিক সমস্যা,
রিসার্চ পেপারের সমস্যা প্রভৃতির সমাধান অনায়াসেই কিভাবে করে দিতেন,
না কি তখন তিনি আদৌ ছিলেন না মানসিক ভারসাম্যহীন?
এ সমস্ত বিষ্ময়কর ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে,
তৎকালীন বিহার সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাঁর প্রাইভেট ট্রিটমেন্ট-এর।
কিন্তু সুফল তাতে কিছুই হয়না!
সে সময়ে পত্নী পরিত্যক্ত ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণের বাড়ির লোকজন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে চলে আসলে,
বেশ কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়েই তিনি উধাও হয়ে যান কোথাও।
এরপর- ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ দীর্ঘ ৪ বছর, পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা তাঁর কোনো মিনিমাম সন্ধান।
মর্মান্তিক পরিণতিতে আবিষ্কারঃ
অবশেষে-
চেনাপরিচিত কারো বিবাহের বরযাত্রী যাওয়ার সূত্রে,
তাঁর ছোটো ভাই অযোধ্যা প্রসাদ সিং একদিন বিহারের কোনো এক রাস্তার কোনায়,
মানসিক ভারসাম্যহীন, ছেঁড়া-নোংরা জামাকাপড়, শরীর।
অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, উস্কো-খুস্কো, ময়লা চুল-দাড়ি অবস্থায়,
অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতে দেখতে পেয়ে যান দাদা বশিষ্ঠকে,
এবং সে অবস্থাতেও দাদা বিড়বিড় করছিলেন ম্যাথের ফর্মূলা ও ইকুয়েশনস্ বলে জানান।
ভাবলে বাকরূদ্ধ ও চরম আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়-
দুর্দমনীয় ও কিংবদন্তি যে গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী তাঁর সম্পূর্ণ জীবন,
বিসর্জন দিলেন শুধু গণিতের জন্যে, তাঁর গোধুলী লগ্নই জমকালো অন্ধকারে গেছিল ঢেকে।
পরিবারের সাথে গ্রামে যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন,
লড়াই করে তো তিনি গেছেনই নার্ভাস ব্রেক ডাউনের সাথে,
বরং দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি ছিলেন সিজোফ্রেনিয়া’র স্বীকার।
বিশ্ববন্দিত এই মহান গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী,
চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বিশ্ব-বিজ্ঞান-মহাকাশের এক সু-উজ্জ্বল নক্ষত্র-
স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি'(E= mc2)-কে।
যদিও এ প্রসঙ্গেও রয়েছে বিস্তর মতানৈক্য।
অন্তিম সময়ে উপেক্ষা, অবহেলাঃ
মাত্রাতিরিক্ত লজ্জা ও গহীন দুঃখজনক বিষয়গুলো হল এখানেই যে-
দেশ তথা সমগ্র বিশ্বের এমন এক মহার্ঘ কোহিনুরের যথার্থ অপব্যবহার!!
২০১৯-এর ১৪ ই নভেম্বর ‘পাটনা মেডিকেল কলেজ’-এ ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণ সিং,
আমাদেরকে চিরবিদায় জানাবার পর, বশিষ্ঠ নারায়ণের পরিবারের অভিযোগ,
মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ করলেও,
অ্যাম্বুল্যান্সের কোনো ব্যবস্থাই করে দেয়নি তাঁরা।
বরং বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে হাসপাতাল চত্বরেই খোলা আকাশের নীচে ফেলে রাখা হয় এই অমূল্য সম্পদকে।
পরে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি চাউর হলে খবর পৌঁছায় প্রশাসনের কাছে,
এরপরই পরিসেবা মেলে অ্যাম্বুল্যান্সের।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য ঘোষণার পর-
ডঃ বশিষ্ঠ নারায়ণ সিং-এর মৃতদেহকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের উদ্দ্যেশ্যে,
তৎকালীন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, হেঁটে আসেন লাল কার্পেটের উপর দিয়ে।
ফলে এ চরম দৃশ্যদূষণ নিয়ে সমগ্র বিহার জুড়ে সে সময় উঠেছিল সমালোচনার ঝড়!
দরিদ্রতার বলয়ে অবস্থান করেও-
দেশ মাতৃকার জন্যে যে মহৎ ও নিঃস্বার্থপ্রায় মানুষটা কিছু করার হার্দিক বাসনায়,
এক লহমায় ছেড়ে চলে আসতে পেরেছিলেন অনায়াসে নাসার মতন স্থানের বিলাস-বৈভব ত্যাগ করে।
জীবদ্দশায় তো দেওয়া যাক ছেড়েই,
তাঁর এই অন্তিম পরিণতিকে পর্যন্ত কেন্দ্র করেও আজ পর্যন্ত রচিত হয়েছে না কোনো গ্রন্থ,
না দেশে-বিদেশে মুক্তি পেয়েছে কোনো মুভি,
আর না সংযোজিত হয়েছে কোন রাজ্যের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর অবদানের এই ইতিহাস!!
এ চরম লজ্জার দায়ভার কাদের?
তাঁর মৃত্যুর পরের বছর,
অর্থাৎ ২০২০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভূষিত করেন দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সম্মান “পদ্মশ্রী” উপাধিতে।
তন্ময় সিংহ রায়