উৎসবের আনন্দে চাপা পড়া এক বাবার ছবি!

উৎসবের ভিড়ে প্রদর্শনঃ

উৎসবের ভিড়ে সবাই আজ দর্শক নয়।
অনেকে ভীষণ ব্যস্ত দেখাতে।
নতুন পোশাক, দামি পারফিউম, ক্যামেরায় কৃত্রিম হাসি,
সবকিছু যেন অন্যকে বোঝানোর জন্যে।
মন বলছে,
এত খরচ, এত পরিশ্রম, দেখবে না কেন?
যেন আনন্দ নয়, প্রতিযোগিতা চলছে প্রমাণ করার।
যেন প্রতি পাঁচ কদমে একেকটা ফ্যাশন শো।

সবার চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য যে মানুষটাঃ

আর সেই নিরন্তর প্রদর্শনীর মাঝে,
একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আবছা হয়ে।
তাঁর কাপড়ের রং ফিকে হলেও সেলাইগুলো বেশ শক্ত।
কারণ ওগুলো শুধু সুতো নয়, দায় দিয়ে গাঁথা।
আধভাঙা প্লাস্টিকের স্যান্ডেলদুটো,
যেন ঝুলে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে।
চমড়ায় নেই কোনো সুগন্ধির মোহ, আছে ধুলোর গন্ধ।

( হে ত্রিকালদর্শী-
কিন্তু যে স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে,
তা ছিল দুর্বোধ্য, অসহ্য, দৃঢ়।
বড় দীর্ঘ ছিল সে আগুন-পথ।
পড়ুনঃ শ্রদ্ধেয় নেতাজী, তোমাকে খোলা চিঠি! )

কাঁধে ভবিষ্যৎঃ

নতুন জামার ভিড়ে ক্রমাগত হাঁটছে পুরনো সেলাই ঘষা সেই শরীরটা।
যেন অতীতের প্রতিটা দিন তাঁর কাঁধে বসে আছে।
কিন্তু না,
কাঁধ জুড়ে আজ তাঁর ছোট্ট ভবিষ্যৎ।
সে অভাবের ভাষা কিছুই জানেই না।

মানুষটা যেন কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না,
কারও প্রশংসাকেও বিশেষ প্রয়োজন মনে করে না।
কারণ সে জানে, প্রচারিত সুখ ক্ষণস্থায়ী,
কিন্তু নীরব আনন্দের আয়ু বেশিদিন।

হিসেব হারানো মুহূর্তঃ

টাকার হিসেব মাথায় চলছে ঠিকই।
আগামীকালের ভাত, বাড়ি ফেরা, ধার, স্ত্রীর ওষুধ।
কিন্তু সন্তানের এক আশায়,
হঠাৎ’ই যেন নিজে থেকে মুছে গেল সব হিসেব-নিকেশ।

ডিম ভাজার গন্ধে স্বপ্নঃ

দূরে দোকান থেকে ভেসে এলো ডিম ভাজার গন্ধ।
মেয়েটার নজর আটকে গেল সেই খাবারে।
ছোট্ট হাতদুটো এগিয়ে এল সামনে,
সেখানে রাখা হল কাগজে মোড়া প্রথম স্বপ্ন।
যেন পৃথিবীর সেরা আয়োজন এতেই লুকিয়ে।
যেন ওটা কোনো সাধারণ খাবার নয়,
রাজপ্রাসাদ থেকে আসা বিশেষ ভোগ।

মেয়েটার প্রথম কামড়ে আমি দেখলাম,
মানব সভ্যতার এক পরম সত্য।
আনন্দের পরিমাপ অর্থ দিয়ে নয়, আসল পরিমাপ,
কারো চোখে প্রতিফলিত আলোর মাধ্যমে।

প্রদর্শন নয়, মেয়ের সুখ বাঁচানোঃ

অনুভব করলাম,
পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ বেঁচে থাকে নিজের সুখ প্রদর্শনের জন্যে।
সেখানে একজন মানুষ কিভাবে নিঃশব্দে পরিপূর্ণ হয় সন্তানের আনন্দ নিশ্চিত করে।

বাস্তব জীবনের মৌলিক পাঠঃ

মনে হল,
জীবনের মৌলিক পাঠ যেন লেখা থাকে ফুটপাতে,
বস্তিতে, বা ভাঙা কোনো ঘরের কোণে।
যেখানে ধুলোমাখা দেয়ালে লেখা নেই কোনো শব্দ,
তবু চোখে চোখ রাখলেই বোঝা যায়,
গরিবের হৃদয় কিভাবে ধৈর্য্য, ভালোবাসা আর আশা ধরে রাখে।
কিভাবে জল দিয়ে গিলে নেয় যন্ত্রণা।

খিদে বয়েও স্বপ্ন কেনা বাবাঃ

দেখলাম,
কিভাবে একজন বাবা,
সাধ্যের সীমা ছাড়িয়ে তাঁর মেয়েকে স্বপ্ন কিনে দেয়।
দেখলাম,
একজন বাবাকে, একজন এমন মানুষকে অনুভবের চেয়ে,
নিজেদের আনন্দ, বিলাস, খুশি, সুখ, স্টেটাস ঠিক কতটা বড়?
দেখলাম,
মাটির প্রতিমার সামনে হাজার রঙের সন্দেশ ছড়িয়ে আছে।
আর তাতে লুকিয়ে আছে কত-শত আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বার্থ।
কিন্তু মাটিতে থাকা মানুষগুলোর সহায়-সম্বলহীন মৃত্যুকেও,
কিভাবে তাঁরা জীবন বলে।

তাকিয়ে দেখলাম,
বাবার কাঁধ যেন আজ ক্লান্ত হয় না,
কারণ তা ভরে আছে এক টুকরো আশার ওজনে।
চারিদিকে ঝকঝকে সাজ, বড় বড় আলো।
তাতে কারো চোখের জলও ঝলমল করে।
কিন্তু এই ক্ষুদ্র কাঁধে বসে থাকা হাসিটুকুর মতন দীপ্তি,
কোনো ঝকঝকে কাঁচে ধরা যায় না।
কারও চাকা যতই বড় হোক,
এ উচ্ছ্বাস বহনের ক্ষমতা থাকে শুধু এই কাঁধেরই।

ছোট্ট হাতের জন্যে বড় প্রশ্নঃ

ভাবলাম,
এই ছোট্ট মেয়েটাও কি তবে ভুগছে কর্মফল?
যার কর্মই শুরু হয়নি, তাঁর আবার ফল কিসের?
আর যদি হয় গত জন্মের, তো পুনর্জন্ম কি তবে সত্যি?
তাও যদি হয়, তবে তা এই বয়স থেকেই?

দেখলাম-
ভগবান নিরুত্তর, নীরব সাক্ষী।

 

তন্ময় সিংহ রায়

Join Our Newsletter

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.

About Articles Bangla

Check Also

একটা দ্বৈত ফ্যান্টাসি দৃশ্য। মাঝের গেটওয়ের দু'পাশে আলো ঝলমলে স্বর্গীয় পথ ও লাভা প্রবাহিত অন্ধকার নরক পথ। একজন সাধু মাঝের পথে হাঁটছেন, উপরে দুই বিশাল তলোয়ারধারী মূর্তি।

মনের গোলকধাঁধাঁ!

মন এক অনন্ত ভ্রমনপথ, যেখানে প্রতিটা চিন্তা জন্মায় আলোয়, আর মরে অন্ধকারে। কখনও সে শিশুর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *